নিজস্ব প্রতিবেদক
০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:২৮ এএম
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) চান্দগাঁও থানার হেফাজতে মারা যাওয়া দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (৬১) ও তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি সাজানো বলে দাবি নিহতের পরিবারের।
তাদের দাবি, কথিত যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন ও তার সহযোগী দুর্বৃত্তদের ৫০ লাখ টাকা দাবি চাঁদা না পেয়ে রনি আক্তার তানিয়া (২৬) নামে এক গৃহবধূকে বাদী সাজিয়ে এ মিথ্যা-বানোয়াট মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার সঙ্গে চান্দগাঁও থানা পুলিশের যোগসাজশও রয়েছে।
আরও পড়ুন >> দুদক কর্মকর্তার মৃত্যুতে তদন্ত কমিটি, দুই এএসআই প্রত্যাহার
মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। যার সি আর নং-৭৩৩। ২৭ সেপ্টেম্বর এই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
৩০ সেপ্টেম্বর পরোয়ানাটি চান্দগাঁও থানায় আসে। এ মামলায় দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় পুলিশ তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকেও (৩৫) গ্রেফতারের জন্য খোঁজে। আর গ্রেফতারের দেড় ঘণ্টা পর পুলিশের হেফাজতে মারা যায় দুদক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ।
রনি আক্তার তানিয়ার মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়
মামলার এজাহারের বিবরণ মতে অভিযোগ আনা হয় মামলার বাদী রনি আক্তার তানিয়া গত জানুয়ারি থেকে তিন হাজার টাকা বেতনে শহীদুল্লাহর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেন। প্রথম দুই মাস বেতন ঠিকমতো দিলেও পরবর্তী মাসগুলোতে কখনও এক হাজার, আবার কখনো দেড় হাজার টাকা বকেয়া রাখা হয়।
মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তার সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতন বকেয়া ছিল। ২৩ আগস্ট রাতে টাকার জন্য গেলে শহীদুল্লাহ তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। একপর্যায়ে তার নির্দেশে তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ার তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এতে তিনি গুরুতর আহত হন।
শহীদুল্লাহর শ্যালকের দাবি
শহীদুল্লাহর শ্যালক কায়সার বলেন, রনি আক্তার তানিয়া নামে কোনও গৃহকর্মী আমার বোনের বাসায় কখনও ছিল না। অথচ তানিয়া নামে এক গৃহবধূ নিজেকে গৃহকর্মী দাবি করে মিথ্যা মামলা করেছে। এটি সাজানো মামলা। কিছু সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ এ মামলাটি করিয়েছে। এ নিয়ে রনি আক্তার তানিয়ার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন কথিত যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন তাকে দিয়ে এই মিথ্যা মামলা করিয়েছেন।
কায়সার বলেন, এই মিথ্যা মামলা দায়েরের পেছনে চান্দগাঁও থানা পুলিশের ইন্ধন থাকতে পারে। তা না হলে, জসিমের চাঁদা দাবির ঘটনায় আমার বোনের স্বামী নিহত শহীদুল্লাহ চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো রনি আক্তার তানিয়ার মামলা পুলিশ তদন্ত না করেই দুলাভাই শহীদুল্লাহকে রাতের বেলায় সাদা পোশাকে এসে টেনেহিঁচড়ে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে গেছে। তিনি অসুস্থ মানুষ। তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ-ইনহেলার পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়নি। পুলিশের টর্চারে আমার দুলাভাই মারা গেছেন।
তানিয়ার স্বীকারোক্তি
বিষয়টির সত্যতা জানতে চাইলে বাদী রনি আক্তার তানিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী গাড়ীচালক। তিন সন্তান নিয়ে আমাদের অভাবের সংসার। মাঝে-মধ্যে জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করতেন। তার কথায় আমি মামলা করেছি। মামলার বিবাদীর সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। তার বাসায় আমি কখনো কাজও করিনি। শুনেছি মামলার আসামি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গ্রেফতারের পর থানায় মারা গেছেন। খবরটি শুনে আমার খারাপ লেগেছে।
তানিয়া আরও বলেন, ঘটনার পর বিষয়টি জানতে কয়েকজন সাংবাদিক আমার কাছে এসেছেন। আমি তাদেরকেও বলেছি, বিবাদীর সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। জসিম আমাকে সাহায্য করতেন বলেই যেভাবে বলেছে আমি সেভাবে মামলাটি করেছি, অভিযোগটি ছিল মিথ্যা-বানোয়াট।
তানিয়া জানান, তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের রত্নপুর গ্রামের মোহাম্মদ হাশেমের মেয়ে। নগরীর চান্দগাঁও থানার নিকটবর্তী এক কিলোমিটার এলাকায় বসবাস করেন তিনি। তার স্বামী ম্যাক্সিমা চালক। তাদের তিন সন্তান রয়েছে।
ঘটনার নেপথ্যে যুবলীগ নেতার চাঁদাবাজি
স্থানীয়রা জানান, নিহত সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন এক কিলোমিটার মহুরি বাড়ি এলাকার পৈত্রিক বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি সর্বশেষ চট্টগ্রামের দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এ উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে ২০০৭ সালের ১২ জুলাই তিনি অবসরগ্রহণ করেন।
শহীদুল্লাহর ছেলে নাফিস শহিদ বলেন, আমার মায়ের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একটি জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। যুবলীগ নেতা জসিমসহ আরও কয়েকজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক বিনা কারণে আমাদের ঘর নির্মাণে বাধা দিয়ে আসছিল। তারা ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। আমরা টাকা দিতে রাজি হইনি। এরপর আমাদের পুরো জমি তারা জোর করে দখল করতে চেয়েছিল।
গত ১৮ আগস্ট তারা আমাদের ভাড়া দেওয়া ঘর ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় আমার বাবা বাদী হয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে চান্দগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। মামলাটি দায়ের করার কয়েকদিন পর অপরিচিত এই নারীকে গৃহকর্মী সাজিয়ে আদালতে মিথ্যা-বানোয়াট এ মামলা দায়ের করেছে। বাবাকে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত আমরা জানতাম না বাবার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৩ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রাতে বাবাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমার চাচারা এবং বেশ কয়েকজন প্রতিবেশি থানায় যান। আমার বাবাকে থানায় নেওয়ার পর কেউ যাতে বাবার সঙ্গে দেখা করতে না পারেন সেজন্য চান্দগাঁও থানার মূল ফটক বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তিনি হার্টের রোগী। তার সব সময় ইনহেলার আর মেডিসিন প্রয়োজন হয়। পুলিশ ইনহেলার ও মেডিসিন বাবার কাছে পৌঁছাতে দেয়নি। বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
শহীদুল্লাহর স্ত্রী ফৌজিয়া আনোয়ার বলেন, আমার স্বামী মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় চকবাজার কেয়ারিতে মিটিংয়ে যাচ্ছেন বলে বাসা থেকে বের হন। পরে শুনলাম চেয়ারম্যান ঘাটার এক পরিচিতজনের ফার্মেসি থেকে তাকে পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকে দুই ব্যক্তি টেনেহিঁচড়ে চান্দগাঁও থানায় নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে খবর আসে আমার স্বামী মারা গেছেন। আমার স্বামীকে পুলিশ টর্চার করে, নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। আমরা এর বিচার দাবি করছি।
এখনও তদন্তে শহীদুল্লাহর করা মামলা
জানা গেছে, ১৮ আগস্ট ভাড়া দেওয়া ঘর ভাঙচুর, অবৈধ দখলের চেষ্টা এবং ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে চান্দগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
আরও পড়ুন >> পুলিশ হেফাজতে দুদকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মৃত্যু
১৯ আগস্ট দায়ের করা মামলায় তিনি নয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও চার থেকে পাঁচ জনকে অজ্ঞাত আসামি করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন—মো. জসিম উদ্দিন (৩৭), মো. জসিম উদ্দিন (৪৬), মো. শাহজাহান (৪৭), মো. শাহীন (৪৩), মো. লিটন (৪৭), মো. মান্নান (৪৫), নুসরাত তাসু (২৩), মো. রিফাত (৩৮) ও মোছা. বানু (৪৭)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গত ১৯ সেপ্টেম্বর জমি দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে নয় জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। আমরা তার মামলা গ্রহণ করেছি। ওই মামলার বেশ কয়েকজন আসামিকেও গ্রেফতার করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন আছে।
প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশের ভূমিকা
চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল মনসুর বলেন, দুদকের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক শহীদুল্লাহর গ্রেফতার ও মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চাঁদা দাবির ঘটনায় শহীদুল্লাহর দায়ের করা মামলায় জসিমকে গ্রেফতার করার বিষয় রয়েছে। কিন্তু পুলিশ তা করেনি। বরং পুলিশের সঙ্গে এই সন্ত্রাসীর দহরম-মহরম থাকার তথ্য মিলেছে।
এ অবস্থায় আদালতের পরোয়ানার কপি পেয়েই শহীদুল্লাহকে গ্রেফতার করতে মাঠে নেমে পড়েছে চান্দগাঁও থানার দুই পুলিশ সদস্য। তারা হলেন—চান্দগাঁও থানার এএসআই মো. ইউসুফ আলী এবং এএসআই এটিএম সোহেল রানা। তারা সাদা পোশাকে অভিযান চালিয়ে শহীদুল্লাকে গ্রেফতার করেন। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) তাদের চান্দগাঁও থানা থেকে প্রত্যাহার করে সিএমপির পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য
ওসি খাইরুল ইসলাম বলেন, শহীদুল্লাহকে ৩ অক্টোবর রাতে গ্রেফতারের পর শরীর খারাপ লাগছে বলে জানান। তখন আমার কক্ষে এনে বসিয়েছি। পরে তার ভাইদের জানিয়ে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে থানায় কোনো প্রকার নির্যাতন করা হয়নি।
সিএমপি অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-পিআর) স্প্রীণা রানী প্রামাণিক বলেন, দুদকের সাবেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে বুধবার (৪ অক্টোবর) তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিএমপি। অনুসন্ধান শেষে মতামতসহ আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন দাখিলের পর অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
অভিযুক্ত জসিম উদ্দিনের বক্তব্য
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, মামলা করেছেন রনি আক্তার তানিয়া। তাকে আমি চিনি না। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এ মামলার সাথেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তানিয়া মামলা করেছেন, আদালতে তানিয়ায় জবাব দিবেন। এতে আমার করার কিছুই নেই।
চাঁদাবাজির বিষয়ে নিহত শহীদুল্লাহর মামলা ও স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, শহীদুল্লাহ মামলা করেছেন শুনেছি। এ বিষয়ে পুলিশ ডাকলে থানায় যাব। আর না হয় আদালতেই হবে সমাধান। এর বাইরে কিছুই বলার নেই বলে জানান জসিম উদ্দিন।