জেলা প্রতিনিধি
২৫ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৮ এএম
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখই এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের তিন মাসে।
শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর ও রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস। এ দিনটিকে ঘিরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে চলছে নানা প্রস্তুতি। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার হিসাবও মিলিয়ে নিচ্ছেন অনেকে।
উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন বলেন, ৩৩টি আশ্রয়শিবিরের সব কটিতে ছোট–বড় করে গণহত্যা দিবসের সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হবে। আশ্রয়শিবিরে প্রায় ছয় লাখ কিশোর-তরুণ-যুবক তাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় তাদের একটি অংশ মাদক-সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্যমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্র্যাবাসন শুরর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর মে মাসে রাখাইন পরিস্থিতি দেখতে যান রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর শেষ হলেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা হয়নি।
গত মে মাসে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়ক পরিবেশ ও পরিস্থিতি আছে কিনা, তা যাচাই করতে গিয়েছিল টেকনাফের রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দল।
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, মিয়ানমারে আমরা খুব জুলুমের (নির্যাতন) শিকার হয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে ছয় বছর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কোনও কূলকিনারা হয়নি। দিন দিন ক্যাম্পের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে ছেলেমেয়েদের পাঠদান করাতে পারছি না। আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘকে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সে অনুসারে নিজ দেশে ফিরতে চাই। আমরা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ফিরতে চাই না। মিয়ানমারে ১৩৫টি জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মতো আমরা সেদেশে বাকি জীবন কাটাতে চাই, আমরা আমাদের অধিকার চাই।
রেশন কমিয়ে দেওয়ায় ক্যাম্পের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আমরা খুব দ্রুত প্রত্যাবাসন চাই। দাতা সংস্থাগুলো রেশন কমিয়ে দেওয়ায় অনেকে হতাশ হয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবু সামা বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য গত কয়েক মাস আগে আমাদের মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখে আসলাম আমাদের জন্য প্রস্তুত রাখা ক্যাম্পগুলো। ওই ক্যাম্পে যাবো না, আমাদের বসতভিটে ফিরিয়ে দিলে যাবো। মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনে আমরা শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে আছি। আবার সেদেশে গিয়ে শরণার্থী হতে চাই না। রাখাইনে ফেলে আসা বসতভিটায় রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা না হলে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা কোনও রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে না।
টেকনাফের লেদা ২৬ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ আলম বলেন, ক্যাম্পে দীর্ঘ ছয় বছর পার হয়ে গেলো। আমরা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত আছি। তবে ক্যাম্প থেকে মিযানমারে তৈরি করা ক্যাম্পে ফিরতে চাই না। আমরা সেদেশে গিয়ে কষ্টের জীবন চাই না। আমাদের নিজেদের গ্রামে নিয়ে গেলে, স্বেচ্ছায় চলে যাবো।
তিনি বলেন, এক হাজার ৪০ টাকা থেকে কমিয়ে এখন ৮৪০ টাকা রেশন দেওয়া হচ্ছে। তা নিয়ে আমাদের চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেকে অভাবের কারণে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতে পাচারসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। ক্যাম্পে এত ঘনবসতি, কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাচ্ছে। এবার আমরা ফিরতে চাই। অন্তত বাকি জীবন নিজ দেশে কাটাতে চাই।
টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা মোমেনা খাতুন (৪৫) বলেন, শুরুতে জনপ্রতি ১২ মার্কিন ডলারের খাদ্যসহায়তা পেতেন রোহিঙ্গারা। এখন কমিয়ে আট ডলারে ঠেকেছে। সাহায্য আরও কমতে পারে।
গত ছয় বছরে তিনবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা সলিম উল্লাহ (৪৬) আক্ষেপ করে বলেন, ‘মিয়ানমার জান্তা সরকার জীবনেও রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার প্রথমে এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। কিন্তু তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সম্মতি নেই। প্রত্যাবাসনের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, গণহত্যা দিবসে আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের ছোট করে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে বড় সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের মংডুতে তৈরি আশ্রয়শিবিরে (মডেল ভিলেজ) রোহিঙ্গাদের রাখার কথা বলে আসছিল। তাতে রোহিঙ্গাদের আপত্তি ছিল। এখন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের রাখাইনে তাঁদের ফেলে আসা জন্মভিটাতে পুনর্বাসনের কথা বলছে। তাতে রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হচ্ছেন।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, আশ্রয়শিবিরে থাকা সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ৮০ শতাংশ প্রত্যাবাসনের পক্ষে। কিন্তু মিয়ানমারের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর আশ্রয়শিবিরে হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপকর্ম ঘটিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।
উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, মধুরছড়া, টেকনাফের জাদিমুরা, নয়াপাড়া, শালবন আশ্রয়শিবির ঘুরে শতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাগরিকত্ব পেলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি। তবে প্রত্যাবাসনের আগে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচার কার্যকরের দাবি জানান তারা।
উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের মনির উল্লাহ (৪৫) নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, আগস্টের পরের কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দমন–পীড়ন, ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালিয়ে আট লাখ রোহিঙ্গাকে জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য করে। এ বছরও আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস পালনের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, উখিয়ার কুতুপালং ও লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে গণহত্যা দিবসের দুটি পৃথক সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন তাঁরা। সমাবেশে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গার সমাগম ঘটানো হবে। সমাবেশ থেকে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর তাগিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সাত দফা বাস্তবায়নের দাবি জানানো হবে। দাবিগুলোর মধ্যে আছে—জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন শুরু করা, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, গণহত্যার বিচার দ্রুত কার্যকর, রাখাইনে ফেলে আসা ধনসম্পদ পুনরুদ্ধার, রাখাইনের নিজ জন্মভিটাতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি।
এ বিষয়ে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, গণহত্যা দিবসকে ঘিরে আশ্রয়শিবিরে নাশকতামূলক কিছু যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে অভিযান অব্যাহত আছে।