জেলা প্রতিনিধি
০৮ আগস্ট ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম
কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সোমবার ফেনীর মুহুরী নদীর ফুলগাজী ও পরশুরামের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে কমপক্ষে ২০টি গ্রাম। যদিও পানি পরশুরাম পয়েন্টে আজ বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভাঙা অংশ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এতে নতুন এলাকায় পানি ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেনীর ফুলগাজীর সদর ইউনিয়নের উত্তর বরইয়া আর উত্তর দৌলতপুর গ্রামের বেড়িবাঁধের দুটি স্থানে এবং পরশুরামের চিথলিয়া ইউনিয়নের অলকা গ্রামে একটি স্থান ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে আজ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গ্রামবাসী জানান, সোমবার ভোরে বাঁধের অংশে ভাঙ্গন দেখা দিলে গাছ কেটে, মাটি দিয়ে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করেও রুখতে পারেনি তারা। পানির প্রচন্ড বেগে বাঁধের আশপাশের উত্তর বরইয়া, বনিক পাড়া, বিজয়পুর, কিসমত বিজয়পুর, বসন্তপুর, জগতপুর এবং পরশুরামের পশ্চিম অলকা, পূর্ব অলকা, নোয়াপুর, অনন্তপুর, চিথলিয়া, ধনীকুন্ডা, রামপুর, রতনপুর, দূর্গাপুর, জয়পুর, ঘনিয়ামোডা, সাতকুচিয়াসহ বেশ কিছু গ্রামে বানের পানি ঢুকে পড়ে। তলিয়ে গেছে আমনের কয়েক শত শত হেক্টর জমি। ভেসে যায় পুকুরের মাছ। ঝুঁকিতে রয়েছে ১২২ কিলোমিটারের বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থান। নদীর উভয় পাড়ের ১২২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের তীরবর্তী এলাকার শত শত পরিবারের হাজার হাজার মানুষের দিন আর রাত কাটছে বন্যার কবলে মানবেতর ভাবে।
জানা গেছে, পরশুরাম-ফুলগাজী-ছাগলনাইয়া উপজেলা নিয়ে ফেনী-১ সংসদীয় এলাকা গঠিত। প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষের বাস এ জনপদে। প্রতিবেশী ভারত হতে উৎস মুহুরী নদী প্রবাহিত হয়েছে এই তিন উপজেলার বুক চিরে। বর্ষায় চির যৌবনা এ মুহুরী নদীর করাল গ্রাসে বানভাসী মানুষের ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
সর্বনাশা বন্যায় সৃষ্ট নদীর ভাঙ্গনে অবহেলিত এ জনপদের মানুষের ধান পানিতে তলিয়ে যায়। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীসহ অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণিকুলসহ শত-শত মৎস্য ঘের বন্যার পানিতে ডুবে অসীম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এসব এলাকার মানুষরা।
উত্তর বরইয়া গ্রামের এনামুল হক বলেন, একদিন আগেই জমিতে দুই একর জমিতে রোপা আমন রোপণ শেষ করেছিলাম। আজ সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখানে আশপাশের ৩০-৪০টি পুকুর ফসলি জমি, মসজিদ, বাড়িঘর সব পানিতে ডুবে আছে এখন। স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করা পর্যন্ত এ জনপদে ক্ষতির পরিমাণ কমবে না বলছেন স্থানীয়রা। মুহুরী নদীর বাঁধ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই।
তাদের ভাষ্যমতে, বন্যাকবলিত মানুষের কষ্ট দেখতে গণমাধ্যমে নিয়মিত সংবাদ হয়, ত্রাণের পরিধি বাড়ে। কিন্তু যখন পানি নেমে যায় তখন বন্যাকবলিত মানুষগুলোর খোঁজ কেউ নেয় না। জীবিকার তাগিদে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে আবার সংগ্রাম শুরু করতে হয়। বছরের পর বছর ধরে চলছে এ দুর্ভোগ। প্রতি বছর অকাল বন্যা, মৌসুমি বন্যা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অজানা নয়। এমনিতেই কৃষকরা ঋণের ভারে জর্জরিত।
স্থানীয় কৃষক সলিম উল্যাহ বলেন, সর্বনাশা মুহুরী নদীর বাঁধ যেকোন মুহুর্তে ভাঙ্গতে পারে। সেজন্য বন্যায় আগাম প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ থাকে না। টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করা ছাড়া উপায় নেই।
নিজেদের দুর্দশার জন্য পান্নি উন্নয়ন বোর্ডের গাফেলতিকে দায়ী করে স্থানীয় এনামুল হক জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ প্রকল্পের পাইপ বাঁধের নিচ দিয়ে নেয়ার সময় ভালো করে না হিলানো, বাঁধ সংলগ্ন স্থানে বালু উত্তোলন, বড় ইঁদুরের গর্ত তৈরির কারণে বাঁধ ভেঙে যায়।
বাঁধ ভাঙনের শিকার দৌলতপুরের কৃষক মুজিবুল হক, মিজানুর রহমান, ওহাব মিয়া এবং ওবায়দুল হক জানান, শুধু ফসলের ক্ষতিই নয়, ঋণের ভারেও জর্জরিত হচ্ছেন তারা ।
তাদের অভিযোগ, প্রতি বছর ভাঙনের পর জায়গাগুলো নামমাত্র মেরামতের জন্য মোটা অংকের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধের স্থায়ী সমাধান হয় না। তাদের দাবী, নদী শাসনের মাধ্যমে সংস্কার করা হলেই এ ভাঙন রোধ সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে ফেনীস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, মাটির বাঁধ এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ এরপর ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী ফুটো করে ফেলে। আর ওই ফুটো পানির চাপে ভাঙ্গন কবলিত হয়। এছাড়া নদীর ধারণ ক্ষমতা ও কম। নদীর কয়েকটি স্থানে আছে ৯০ ডিগ্রীর মতো বাঁক। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন আছে।
প্রতিনিধি/একেবি