জেলা প্রতিনিধি
০৯ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
দেশের সর্বোত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়া। এর অবস্থান পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার দূরে (উত্তর-পশ্চিমে)। ভ্যান-রিকশা বা বাসের জন্য অপেক্ষা করে এখন আর সময় নষ্ট করে না এই উপজেলার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল এন্ড কলেজের মেয়েরা। এই প্রতিষ্ঠানের মেয়েরা খেলাধুলায়, শিক্ষায় সারাদেশে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। বিশেষ করে স্কুলটি জাতীয় পর্যায়ে হ্যান্ডবল খেলায় ১৩বার চাম্পিয়ান ও ভলিবলে ৩বার চাম্পিয়ান হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় হ্যান্ডবল নারী টিম ও বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। স্কুলটি ১৯৮৩ সালে স্থাপিত হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ শতাধিত। সনামধন্য এ স্কুলটি পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরের সীমান্তবর্তী কাজীপাড়া এলাকায় অবস্থিত। উপজেলার বাংলাবান্ধা, সিপাইপাড়া, তিরনইহাট, শালবাহান, রনচন্ডি, তেঁতুলিয়া সদর, দর্জিপাড়া, শারিয়াল, আজিজনগর, মাথাফাটা, কালান্দিগছ, মাঝিপাড়া এলাকা থেকে আগত মেয়েরা পড়াশোনা করে।
প্রতিষ্ঠানটির মেয়েরা দলবেধে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করেন। সমাজে মেয়েদের সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করায় প্রথমদিকে অনেকেরই নানারকম মন্তব্য থাকলেও সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই এলাকার ছাত্রীরা দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারাও পারে। পিছিয়ে থাকতে চায় না। ফলাফল— গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করে তারা সময়মতো বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারে। ফলাফলও ভালো হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭-৮ কিলোমিটার দূরের শিক্ষার্থীরাও এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। ১৫-২০ বছর আগে ছেলেরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করলেও মেয়েদের ভ্যানে ও পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হতো। দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের যৌথ চেষ্টায় মেয়েদেরকেও সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছে। ১২-১৫ বছর আগে হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রী সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাতায়াত শুরু করে। এরপর এর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে এর সংখ্যা। বর্তমানে শতাধিক ছাত্রী নিয়মিত সাইকেলে নিয়ে যাতায়াত করছে। শুধু নিজেরা চালিয়ে স্কুলে আসে তা নয়, ছাত্রীরা তাদের বান্ধবীদেরকেও সাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে আসা-যাওয়া করে।
শারিয়ালজোত এলাকার শারমিন সুলতানা ঢাকা মেইলকে বলেন, ৮ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসি। আমার আগে কারও সাইকেল ছিলো না। বাবা কষ্ট করে সাইকেল কেনার পর ঠিক সময়ে স্কুলে যাতায়াত করতে পারি।
নবম শ্রেণির ছাত্রী আরেফিন আকতার বলেন, আগে বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। তাতে ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারতাম না। বাবা অনেক কষ্ট করে সাইকেল কেনার পরে আমি সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করি। এখন আর সমস্যা হয় না।
আরেফিন আরও বলেন, এখন আমি নিয়মিত ক্লাস করতে পারি এবং পড়াশোনাও ভালো হচ্ছে। তবে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াতের সময় রাস্তার পথচারী ও যানবাহন সাইড দিতে চায় না। গতবছর সাইকেল চালানোর সময় পড়ে গিয়ে আমার হাত ভেঙে যায়।
ওই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী বিথি আক্তার বলেন আমার বাড়ি সীমান্ত গ্রাম শারিয়াল জোতে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। এক সময়ে ভ্যানে ও পায়ে হেঁটে স্কুলে চলাচল করতাম। তখন ঠিক সময়ে ক্লাসে যেতে পারতাম না। ভ্যান ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত টাকা দিতেও বাবা-মার অসুবিধা হতো। তখন আমরা কয়েকজন ছাত্রীরা মনে করলাম ছেলেরা যদি সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? তখন থেকে স্যার ও আমাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে সাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত নেই। বাড়িতে ও গ্রামের ফাঁকা জায়গায় সাইকেল চালানো শিখে আমরা কয়েকজন স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করি।
আজিজনগর এলাকার ৮ম শ্রেণীর এক ছাত্রী জানায়, এই স্কুলে ১৫টি গ্রামের মেয়েরা পড়াশোনা করে। ছেলেদের মতো মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে।
‘প্রথমদিকে সাইকেল চালাতে লজ্জা পেতাম। এখন আর লজ্জা পাই না।’
‘অভিভাবকেরা এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। মেয়েরা যে ছেলেদের মতো সব কাজই করতে পারবে, এই আত্মবিশ্বাসটা এই এলাকার মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তবে স্কুলে আগের তুলনায় আমাদের স্কুলের ছাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
একই স্কুলের নবম শ্রেণীর মেহেরুন আক্তার বলেন, ‘মেয়েদের সাইকেল চালানো খুব স্বাভাবিক। তবে ৯ম শ্রেণিতে ওঠার পর এখন আর আমি সাইকেল চালাই না।’
সীমান্তবর্তী আজিজনগর গ্রামের সড়কপথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলো ৭ম শ্রেণির সিনথি আক্তার। কথা হয় তার সাথে। সে জানায়, তার অন্যান্য বান্ধবীরাও একসাথে সাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে।
অভিভাবক কাজী মকছেদুর রহমান বলেন, ‘১৫ বছর হয়ে গেলে মেয়েদের বিয়ের চিন্তা করেন বাবা-মা। তখন বাজারে বা কলেজে সাইকেল চালিয়ে যাওয়াটা ঠিক সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না অনেকেই। তবে কিশোরী বয়সে মেয়েদের সাইকেল চালানো এখানে সহজভাবেই নেন সবাই।’
তেঁতুলিয়া উপজেলার কিশোরীদের সাইকেল চালানো, তাদের স্বাধীনতার প্রকাশ বলে মনে করেন তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতানা রাজিয়া।
তিনি বলেন, একজন মেয়ে স্বাভাবিকভাবে ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে চলাচলের স্বাধীনতা পেলে নিজেকে অনেক বড় ফ্রেমে চিন্তা করতে পারেন। নিজের ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর সাহস পান। এই অঞ্চলে এখন মেয়েদের স্কুলে যাওয়া যেমন বেড়েছে, তেমনি বাল্য বিয়েও কমে গেছে। নারীদের ওপর কোনও নির্যাতনের প্রতিবাদ নারীরাই করতে পারছে। সাইকেল তার অনুপ্রেরণা যোগায়, সাহসিকতা শেখায়।
ওই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, অভিভাবকেরা এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। মেয়েরা যে ছেলেদের মতো সব কাজই করতে পারবে, এই আত্মবিশ্বাসটা এই এলাকার মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তবে স্কুলে আগের তুলনায় আমাদের স্কুলের ছাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক বলেন, ‘আগে মেয়েরা অনেক দূর থেকে হেঁটে কষ্ট করে আসত। তখন রাস্তাঘাটও ছিল না। যখন রাস্তাঘাট হলো, আমরাও মেয়েদের বাইসাইকেল নিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করেছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। এটা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।’
সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসতে এখন সময় কম লাগছে উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে এবং নিয়মিত ও সময়মত স্কুলে উপস্থিত হতে পারছে শিক্ষার্থীরা। যার কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও বেড়েছে। প্রতিবছরই এই বিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট করছে।
এএ