জেলা প্রতিনিধি
২২ জুন ২০২৩, ০৩:৪৬ পিএম
মনোয়ারুল ইসলাম শাহীন পেশায় শিক্ষক। কিন্তু এলাকায় তিনি পরিচিত আদর্শ খামারি হিসেবে। ১৯৯৪ সালে শুরুটা করেছিলেন গরুর দিয়ে, তারপর ২০০৭ সালে পোলর্ট্রি এবং ২০১১ সালে কবুতরের খামার গড়ে তুলেন তিনি। তবে তিনি সবচেয়ে সফল হয়েছেন ছাগলের খামার দিয়ে। যেখান থেকে তার বার্ষিক আয় হয় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা।
শাহীনের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের পোড়ানগরী গ্রামে। বাড়ির পাশের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত তিনি। স্কুলের অবসরে ব্যতিক্রমী এক খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। যেখানে তোতাপুরি, হরিয়ানা, বিটল, শিরোহী ও ব্লাক বেঙ্গল জাতের ৭৮টি ছাগল রয়েছে।
ব্লাক বেঙ্গলের ৪টি ছাগল ছাড়া সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার ছাগল রয়েছে তার খামারে। গত ছয় বছরে ছাগল বিক্রি করে তিনি আয় করেছেন ৩৬ লাখ টাকা। এখন তার খামারে যে সংখ্যক ছাগল রয়েছে তার দাম হবে ৫০ লাখ টাকা।
ছাগলের খামার গড়ে তোলা প্রসঙ্গে শাহীন বলেন, ২০১৭ সালে নাটোরে ঘুরতে গিয়ে তোতাপুরি জাতের ছাগল চোখে পড়ে। তোতাপাখির মতো বাঁকা মুখের এই ছাগল আমার পছন্দ হলে সেদিনই ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনে নেই। কিছুদিনের ব্যবধানে একই প্রজাতির আরও ছয়টি ছাগল কিনি। সেই ৭টি ছাগল দিয়েই শুরু হয় খামারের যাত্রা। সেসময় ৭টি ছাগল কিনতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৪ লাখ টাকা। এরপর ক্রমান্বয়েই বেড়েছে ছাগল তার খামারে। তোতাপুরি ছাগলের পাশাপাশি অন্যান্য প্রজাতির ছাগলও যুক্ত করেছেন খামারে।
শাহীনের দাবি, শিবগঞ্জ উপজেলা তো বটেই, বগুড়া জেলাতেও তার খামারের মতো বড় কোনো ছাগলের খামার নেই। তার এই খামারে বর্তমানে হরিয়ানা জাতের ১০টি, বিটল ও শিরোহী জাতের ৩টি করে এবং ব্লাক বেঙ্গল জাতের ৪টি ছাগল ছাড়াও ৬২টি তোতাপুরি জাতের ছাগল রয়েছে।
অনেকেই শাহীনের খামারকে তোতাপুরি ছাগলের খামার নামে চেনে। তোতাপুরি ছাগল তার মুখের গঠনে চেনা যায়, হরিয়ানা ছাগল চেনা যায় তার দীর্ঘ কান—যা কলার খোসার মতো দুই ভাজে থাকে আর বড় বড় পেঁচানো শিং দেখে। বিটল জাতের ছাগল আকৃতি বড় চোখ একেবারেই সাদা আর শিরোহীর কান মাঝারি, গায়ে ছোপ ছোপ দাগ থাকে, অনেকটা হরিণের রঙের মতো।
বগুড়া শহর থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাছেই পোড়ানগরী গ্রামের অবস্থান। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পূর্বদিকের এই গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে ছাগলের খামারটি।
শাহীন জানান, আগে শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সেখানে শিক্ষকতা করার সময় ১৯৯৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন গরুর খামার (ডেইরি ফার্ম)। সেখানে সফলতা পেয়ে ২০০৭ সালে পোল্ট্রি খামার করেন। ক্রমান্বয়ে পোল্ট্রি খাতে লোকসান হতে থাকলে ২০১১ সালে সবগুলো মুরগি বিক্রি করে দেন। এরপর শখের বসে গড়ে তোলেন কবুতরের খামার। নানা প্রজাতির ৫০০ কবুতর ছিল তার সেই খামারে। ২০১৩-১৪ সালে কবুতরের বাজারে ধস নামে। এ কারণে কবুতরের খামারও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুধু ডেইরি ফার্মটিই টিকে ছিল। এখনও সেই ফার্মে ২২টি গরু রয়েছে। ২০১৭ সালে নাটোরে ঘুরতে গিয়ে তিনি তোতাপুরি জাতের ছাগল দেখেন। তোতাপাখির মতো বাঁকা মুখের এই ছাগল তার পছন্দ হলে সেদিনই ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনে নেন। এরপর কিছুদিনের ব্যবধানে আরও ৬টি ছাগল কেনেন একই প্রজাতির। সেই ৭টি ছাগল দিয়েই শুরু হয় তার খামারের যাত্রা। সেসময় ৭টি ছাগল কিনতে তার খরচ পড়ে প্রায় ৪ লাখ টাকা। সেই যে শুরু এরপর ক্রমান্বয়েই বেড়েছে তার খামারের ছাগল। তোতাপুরি ছাগলের পাশাপাশি অন্যান্য প্রজাতির ছাগলও যুক্ত করেছেন খামারে।
শাহীন জানান, দেশি ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বছরে দুইবার এবং একই সঙ্গে দুই বা তার অধিক বাচ্চা দিলেও তোতাপুরি সাত থেকে সাড়ে ৭ মাস পরপর বাচ্চা দেয়। একটি থেকে দুটি বাচ্চা জন্মে। বড় ছাগলের চেয়ে এই ছাগলের বাচ্চার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। কারণ একটি ছাগল ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। এক্ষেত্রে যারা বড় ছাগল কিনেন তারা জানেন না সেটির বয়স কত হয়েছে এবং আর কতবার বাচ্চা দিবে, কিন্তু বাচ্চা কিনলে তারা নিশ্চিত থাকেন যে অন্তত ১২ থেকে ১৫ বছর বাচ্চা পাবেন। এ কারণে বড় ছাগলের চেয়ে বাচ্চার চাহিদা বেশি । ফলে তুলনামূলক বাচ্চা ছাগলের দামও বেশি। তিন থেকে ৪ মাস বয়সী একটি বাচ্চা বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়।
এবার তার খামারের সাতমাস বয়সী একটি ছাগল বিক্রি হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। শাহীন বলেন, প্রতিবছর খামারে যে পরিমাণ বাচ্চার জন্ম হয় তা হিসাব করলে খামার থেকে বার্ষিক আয় হয় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা।
খামার গড়তে খরচের বিষয়ে তিনি জানান, দেশী ছাগলের চেয়ে বিদেশী জাতের ছাগল প্রতিপালনে কিছুটা সতর্ক থাকতে হয়, বিশেষ করে তোতাপুরি ছাগলের জন্য। এই ছাগলের জাতটি ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। এ কারণে সর্দির আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া কোনো রোগ হয় না।
ঠান্ডা থেকে রক্ষা করতে রাতে তাদের একটি ঘরের মেঝে থেকে উঁচুতে পাটাতন বিছিয়ে সেখানে রাখতে হয়। এতে করে ছাগলের মল-মূত্র সেই পাটাতনের ফাঁক গলে নিচে চলে যায়, ফলে ঠান্ডায় আক্রান্ত হয় না। এছাড়া ঘাস-ভূষি আর খড়কুটা খাওয়ালেই চলে।
তিনি বলেন, একটি গরু পালনের চেয়ে একটি ছাগল পালন করলে ১০ গুণ কম খরচে দশগুণ বেশি লাভ। কারণ গরু পালনে যে পরিমাণ খাবার প্রয়োজন হয়, ছাগলে ততো খাবার যেমন দরকার নেই, একইভাবে গরু একটি নির্দ্দিষ্ট আকৃতির বড় না হলে তা বিক্রি করে দাম পাওয়া কঠিন, কিন্তু ছাগলের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৪ মাসের বাচ্চার চাহিদাই বেশি। গরুর ক্ষেত্রে বছরে একটিমাত্র বাচ্চা পাওয়া যাবে, আর ছাগলে ১৫ মাসে কম হলেও তিনটি বাচ্চা পাওয়া যাবে। এতে প্রতিটি বাচ্চা ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করলেও দেড় লাখ টাকা অনায়াসে পাওয়া সম্ভব, কিন্তু গরুর ক্ষেত্রে কোনভাবেই পরিপূর্ণ বয়স না হলে এই দাম পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তার খামার থেকে গত ছয় বছরে ৩৬ লাখ টাকার ছাগল বিক্রি করেছেন। এখনও তার খামারে যে পরিমাণ ছাগল রয়েছে বাজার মূল্যে তার দাম হবে অন্তত ৫০ লাখ টাকার ওপরে।
তিনি বলেন, ছাগল বিক্রির জন্য তাকে কোনো হাট-বাজারে যেতে হয় না। অনলাইনে বিক্রয় উপযুক্ত ছাগলের ছবি বা ভিডিও দিলেই ক্রেতারা যোগাযোগ করেন, দরদাম ঠিক হলে তারা এসে পছন্দের ছাগল নিয়ে যান। এভাবেই গত ৬ বছর ধরে ছাগল বিক্রি করছেন তিনি।
বগুড়া শহর থেকে কোরবানির জন্য ছাগল কিনতে এসেছেন হাবিব নামের এক ক্রেতা। তিনি বলেন, তোতাপুরি ছাগল খুব সৌখিন। তাই আমি এই খামারে ছাগল কিনতে এসেছি। আমার যে ছাগল পছন্দ হয়েছে তার দাম চাচ্ছেন ৬০ হাজার টাকা। কিছু কম করলে আমি কিনবো। এই খামারের সব গুলো ছাগলই দেখার মতো।
শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেউলীতে মনোয়ারুল ইসলাম শাহীনের খামারটি উপজেলার মধ্যে একটি ব্যতিক্রম খামার। সেখানে একসঙ্গে এতো ছাগল আছে যা পুরো উপজেলার আর কোন খামারে নেই। তিনি নিয়মিত ছাগলের ভ্যাকসিনসহ নানা পরামর্শ প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে গ্রহণ করেন। তোতাপুরি বা তোতামুখী একটি উন্নত জাতের ছাগল। সাধারণত ৮০ থেকে ৯০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে । আকারে বড় এবং ওজনে বেশি হওয়ায় বাজারে এই ছাগলের চাহিদাও ভালো। তোতাপুরি ও হরিয়ানা জাতের ছাগল দেখতে সুন্দর, তাই এই দুই প্রজাতির প্রতি মানুষের আগ্রহও বেশি। এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এই অঞ্চলে তা প্রতিপালন সহজ। অন্যান্য খামারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ব্লাক বেঙ্গলের পাশাপাশি এই জাতের ছাগল পালনে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিনিধি/এইচই