images

কৃষি ও পরিবেশ

ধানের বাম্পার ফলনেও মুখ মলিন কৃষকের

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

২৭ মে ২০২৩, ০৩:১৬ পিএম

উত্তরের জেলা দিনাজপুর, নীলফামারী ও রংপুরে ধানের বাম্পার ফলন হলেও সেই তুলনায় দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। ধান রোপন করা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে আনা পর্যন্ত যে খরচ সেই তুলনায় দাম নেই ধানের। এর ফলে ভালো ফলন পেলেও হতাশ কৃষক।

কৃষকরা জানান, এবার উত্তরের এই তিন জেলায় প্রচুর ধান হয়েছে। কিন্তু কীটনাশক, সার থেকে শুরু করে আবাদে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তেমন লাভবান হচ্ছেন না তারা। বিশেষ করে যারা বর্গাচাষি তাদের লাভ নেই বললেই চলে।

কৃষকরা বলছেন, যে টাকা বিনিয়োগ করে তারা ধান চাষ করছেন সেই টাকা তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে আগের মতো হিসাব মিলছে না ধান চাষে। নিজের শ্রম দিয়ে এত কষ্ট করে আবাদের চেয়ে চাল কিনে খাওয়াই সাশ্রয় বলে মনে করছেন তারা।

গত সোম ও মঙ্গলবার দিনাজপুর ও নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জমিতে ধান পেকে আছে। কিন্তু কৃষক ধান কাটছে না। আবার যারা কাটছেন তারাও কম শ্রমিক নিয়ে তাদের সঙ্গে ধান কাটছেন। কেউ আবার নিজে প্রতিদিন অল্প অল্প করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জমির ধান কাটছেন। খরচ বাঁচাতে অনেকে শুধু ধান কাটছেন। এরপর সেগুলো ভ্যানে করে আলাদা খরচে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজে সেই ধান মাড়াইয়ের কাজ করছেন।

দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার দাগলাগঞ্জ গ্রামের কৃষক সুজন রায় (৪০) কাজ করেন মিষ্টির কারিগর হিসেবে। এই পেশার বাইরে প্রতি বছর অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান আবাদ করেন। এই ধানে তার সংসারে বছরের অর্ধেক চলে যায়। এবারও তিনি এক বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু ধান আবাদ করে বিপাকে পড়েছেন। জমিতে ধান পেকে গেলেও এখনো কাটতে পারেননি। শ্রমিকের উচ্চ মজুরি ও বর্গা সব মিলে তার কাছে ধানচাষ করা এখন বোঝা মনে হচ্ছে।

Paddy (3)

সুজনের সঙ্গে কথা হয় দাগলাগঞ্জ পার হয়ে ক্যানেলের বাজারের মুখে। অটোরিকশায় বসে তিনি কষ্টের কথা বলছিলেন। সুজন জানান, আগে ধান আবাদ করে চার মণ ধান দিয়ে এক বিঘা জমিতে ধান কাটা যেত। শ্রমিক খরচও কম ছিল। কিন্তু এখন আট মণ ধান লাগছে। বিঘা প্রতি ৫ হাজার টাকা ছাড়া ধান কাটছেন না শ্রমিকরা।

কথা হয় ধানের পাইকার (পাইকারি ব্যবসায়ী) রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। গত ৩০ বছর ধরে উত্তরের জেলা দিনাজপুরের বিভিন্ন গ্রামোহাটে ধান কিনে তা বড় ব্যবসায়ীর কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এবার সরকার যে ধানের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই দরে কিনলে মহাজন লাভ দিতে পারে না। এজন্য আমরা ১২০০ টাকার ধান ৯০০-৯৫০ টাকা কিনছি। তারপরও সেটার বেশিরভাগ জমি থেকে তুলে মাড়াই করা অবস্থায়। আর তাতে কাঁচা ধান বেশি। সে কারণে প্রকৃত কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রফিকুলের মতে, কৃষক খুচরা কত দরে বিক্রি করবে আর পাইকারি দরে কত বিক্রি হবে সরকার যদি তা নির্ধারণ করে দিত, তাহলে কৃষককে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৫ লাখ ৬২৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল৷ প্রতি জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে ৩ দশমিক ৬ টন। সেই হিসেবে ধানের আবাদ খারাপ হয়নি। এর মধ্যে নীলফামারীতে এবার বোরো মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৮১ হাজার ৭০০ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয় ৮১ হাজার ৭১০ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৬৬ হাজার ৭৮০ মেট্রিক টন।

ঠাকুরগাঁও জেলায় বোরো মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬০ হাজার ১৫০ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয় ৬১ হাজার ৬৫০ হেক্টর। দিনাজপুর জেলায় ১ লাখ ৭১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। তবে চাষ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। পঞ্চগড়ে ৩৩ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, এবার জেলায় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। অর্জিত হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় এক হাজার হেক্টর বেশি। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ফলনের হিসাব ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন।

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার চাপানিরহাট ইউনিয়নের কৃষক কামাল উদ্দিন জানান, তিনি এবার পাঁচ বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। তিন বিঘা জমির ধান ইতোমধ্যে কেটে ঘরে তুলেছেন। তিন বিঘা জমির ধান কাটার জন্য তাকে ব্যয় করতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। এখনো দুই বিঘা জমির ধান কাটতে পারেননি। ভাবছেন কাটা ধান বিক্রি করে তারপর ধান কাটবেন।

paddy-2

কামাল উদ্দিন বলেন, আগের বার তিনি প্রতি বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছেন মাত্র ১০ হাজার টাকায়। কিন্তু এবার সার,মজুরি ও কীটনাশকসহ বীজের দাম বাড়ায় তা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার টাকায়। ফলে কোনোভাবে চাষের খরচই উঠছে না।

তিনি বলেন, ‘এখন আর আবাদ করে লাভ হয় না। বাপ-চাচায় ধান আবাদ করে আসছে। তাই আমরাও এখন আবাদ করতেছি। তাছাড়া তো উপায় নাই।’

কৃষকরা আরও জানান, হাটগুলোতে খুচরা দরে ধানের দাম মণপ্রতি ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে কাঁচা ধানের দাম আরও কম পাচ্ছেন কৃষকরা। ফলে প্রতি মণে তাদের ১৫০ টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে। প্রতি বিঘায় ৩০ মণ ধানের ফলন হলে বিঘা প্রতি সাড়ে ৪ হাজার টাকা ক্ষতি গুণে ধান কাটতে হচ্ছে। মাঝে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম বাড়ায় এবার সেচের দামও বেড়েছে।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র রায়ের দাবি কৃষক ধানের খারাপ মূল্য পাচ্ছে না। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘সরকার তো ১২০০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখানে একটা বিষয় আছে, সেটা হলো কৃষকরা প্রতি ফসলে চাষ শেষে চাষের খরচ তুলতে ধান বিক্রি করে দেন তারা। এই প্রবণতা শতভাগ কৃষকের। তারা মূলত বিনিয়োগকৃত পুঁজি তুলতেই ফসল বিক্রি করেন। এর ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কম দামে কেনার সুযোগ পায়। তারা চাষে বিনিয়োগ পুঁজি তোলার জন্যই মূলত এই সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাদের বিক্রির প্রবণতা যখন কমে যাবে, তখন তারা দাম পাবেন।

এমআইকে/এমআর