বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

খেলার জায়গা কই?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২২, ০৯:৩৪ এএম

শেয়ার করুন:

খেলার জায়গা কই?

রাজধানীর বাসাবোর বালুর মাঠে দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছেন রাহেলা বেগম। তাদের মধ্যে একজন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, আরেকজনের বয়স আড়াই বছর। বালুর মাঠ একটু খোলামেলা জায়গা হওয়ায় এবং আশপাশে কোনো মাঠ না থাকায় বিকেল থেকেই প্রচুর জনসমাগম হয় এখানে। মাঠের এক কোনায় দু-ভাইবোনই উৎফুল্ল মনে বল খেলেছিল।

কথা হতেই রাহেলা বেগম বললেন, ‘আমার বাসা মুগদা এলাকায়, এখান থেকে খানিকটা দূরে। এখানে আসতে প্রায় একশ টাকা রিকশা ভাড়া গুণতে হয়। তাও বাচ্চাদের একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য এখানে মাঝেমধ্যে নিয়ে আসি। খুব মজা পায় বাচ্চারা। আমার বাসার আশপাশে যদি ছোট্ট একটু খেলার জায়গা থাকত, তবে প্রতিদিন একটু সময়ের জন্যও বাচ্চাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারতাম। বাচ্চারা কিছুক্ষণের জন্য বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেত।’


বিজ্ঞাপন


দুই সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা বাইরে খেলেতে যেতে চায়। আমার বাসার আশপাশে কোনো খেলার জায়গা না থাকায় তাদেরকে নিয়মিত কোথাও নিয়ে যেতে পারি না। আরা বাসায় যতক্ষণ থাকে সারাক্ষণ মোবাইলে গেমস খেলে। কার্টুন দেখে। এভাবেই সময় কাটায়। নিয়মিত খেলার স্পেস দিতে পারলে হয়তো মোবাইলে গেমস খেলা, কার্টুন দেখার আসক্তি কেটে যেত।’

শুধু রাহেলা বেগমের সন্তানই নয়, নগরের অধিকাংশ শিশুই একটু খেলার জায়গার অভাবে কিংবা বাবা-মায়ের ব্যস্ত সময়ের অজুহাতে ঘরের ভেতর বন্দী জীবনযাপন করছে। সময় কাটাচ্ছে মোবাইল গেমস, কম্পিউটারসহ নানা ডিভাইসের সঙ্গে। আর এতে ডিভাইসের সঙ্গে চরমভাবে আসক্ত হচ্ছেন কোমলমতি শিশুরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু বিনোদন বা খেলাধুলার স্পেস পাচ্ছে না শিশুরা। বাবা মাও ঠিকমতো সময় দিচ্ছেন না। ফলে শিশুরা ডিভাইসে আসক্তি হচ্ছে। আর এই ডিভাইস আসক্তির মাধ্যমে কোমলমতি শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। পাশাপাশি ডিভাইস আসক্তি একদিকে শিশুদের যেমন মেধা ধ্বংস করছে, তেমনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে কর্মস্পৃহা।

এ সমস্য শুধু শহরেই নয়, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও পর্যাপ্ত খেলার জায়গার অভাবে এমন স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন ডিভাইসে ঝুঁকছে। তবে শহরে তুলনামূলক অনেক বেশি। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির পর থেকেই এ ডিভাইস আসক্তি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে।


বিজ্ঞাপন


sishu

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সাহিদা বেগম বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে সন্তান, একজন ক্লাস থ্রিতে পড়ে, আরেকজন হাঁটতে শিখছে। বড় বাচ্চাটা বাসায় যতক্ষণ থাকে প্রায় সারাদিন মোবাইল ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। কার্টুন দেখে, গেমে খেলে। আর ছোটা বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর সময় মোবাইলে ভিডিও না চালু করে দিলে খেতেই চায় না। কি করব- তাদের তো খেলাধুলা করার স্পেস দিতে পারছি না।’

একই এলাকা নাজমুল নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বাচ্চার (ছেলে) বয়স দুই বছর চলতেছে। তার বয়স এক বছর হওয়ার আগে থেকেই মোবাইল ফোন ছাড়া কিছুই বোঝে না। তার হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার কান্না থামাতে মোবাইল হাতে দেওয়ার লাগে। রাতে ঘুমাতে প্রায় একটা-দুইটা বেজে যায়।’

এরোকম দু-একজন নয়। শহর এলাকার প্রায় শতভাগ শিশুই স্মার্টফোনে আসক্ত। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। প্রায় সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই একই অবস্থা। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম। ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে।

sishu

‘বাংলাদেশে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শীর্ষক সমীক্ষার অংশ হিসেবে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০-১৭ বছর বয়সী ১ হাজার ২৮১ জন শিশুর ওপর একটি জরিপ চালায় সংস্থাটি।

সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু তাদের বয়স ১১ বছর হওয়ার আগেই ডিজিটাল বিশ্বে প্রবেশ করতে শুরু করে। যদিও বেশি বয়সী শিশুরা কম বয়সী শিশুদের চেয়ে অধিক মাত্রায় সাইবার নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে, তবে সার্বিকভাবে সব শিশুরাই ক্ষতিকর কনটেন্ট, যৌন হয়রানি এবং সাইবার নিপীড়নের আশঙ্কা রয়েছে।

জাবির এই অধ্যাপক বলেন, আমরা একটা পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতি পাঁচ বছরে একটি করে খোলার জায়গা বা মাঠ কিংবা পার্ক তৈরি করবে। তাহলে আমরা প্রতি পাঁচ বছরে ঢাকা শহরে ১৩৯টি করে খোলা জায়গা বা মাঠ পাব। যেখানে আমাদের শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে। আর একজন কাউন্সিলরের জন্য প্রতি পাঁচ বছরে এটা খুব কঠিন কাজ না। একটু আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলেই সম্ভব।

বিষয়টিতে ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনিরা হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশে শিশুরা ডিভাইসে আসক্ত হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাবা-মা সন্তানকে ঠিকমতো সময় না দেওয়া, শিশুদের পর্যাপ্ত বিনোদন বা খেলাধুলার জায়গা না থাকা ও এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। বাচ্চারা যে মজা করে পড়াশোনা করবে সেই অবস্থা নাই। এখন তারা মনে করছে স্কুল মানেই হচ্ছে একগাদা হোমওয়ার্ক, অনেকগুলো সাবজেক্ট, কোচিং, টিউশনি। বাচ্চারা যেই বয়সে খেলাধুলা করবে, আনন্দ করবে এবং স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা করবে সেটা কিন্তু তারা পারছে না। এখন শহরের যারা বাবা-মা আছেন অধিকাংশ পরিবারেই দুইজনেই ব্যস্ত থাকে। তাই তারা বাচ্চাদেরকে ওভাবে সময় দিতে পারছে না।

মনিরা হাসান বলেন, খেলাধুলা বা বিনোদনের পর্যাপ্ত স্পেস না থাকায় বাচ্চারা সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন ডিভাইস বা স্মার্টফোন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আগে যেমন যৌথ পরিবার ছিল, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একক পরিবার। যৌথ পরিবারে শিশুরা দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, আন্টি তথা পরিবারের অনেক মানুষজনের সঙ্গে মিশতে পারত। কিন্তু এখন সেটা এখন পারছে না। এভাবে বিভিন্ন কারণে শিশুদের বিনোদনের জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারা বিনোদনের কোনো স্পেস পাচ্ছে না। এতে তারা আসক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি। মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখে কার্টুন দেখে সময় কাটাচ্ছে। এতে বাচ্চাদের শারীরিক মানসিক অনেক ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, নিঃসন্দেহে ডিভাইস আসক্তি শিশুদের অনেক বড় সমস্যা। প্রথমত, জন্মের পর থেকেই একটা শিশুর ব্রেইন ডেভলপমেন্ট শুরু হয়। আমরা তাকে যা শেখাই সে সেটাই গ্রহণ করে। বাচ্চা ছোট থাকতেই যখন তার হাতে আমরা ডিভাইস তুলে দেই। প্রথমে হয়তো কান্না থামাতে অল্প একটু দিলাম, এভাবে ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, একজন মা যখন বাচ্চাকে সময় দেয়, বাচ্চাকে ছড়া গান শোনায় তখন বাচ্চাও সেভাবে মায়ের সম্পর্কযুক্ত হয়। আবার যখন সেই বাচ্চার হাতে ডিভাইস তুলে দেওয়া হয়। তখন সে ধীরে ধীরে ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হতে থাকে। এভাবে ডিভাইসে আসক্তি হওয়ার কারণে শিশুর ব্রেইন বিকাশে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা আরেকটা বিষয় দেখি তা হচ্ছে মায়েরা ডিভাইস চালু করে দিয়ে বাচ্চাদেরকে খাওয়ায়। একটা বাচ্চা যখন অন্যমনস্ক হয়ে খাবার খায় তখন তার হজমে সমস্যা হয়। আর ডিভাইসের সব থেকে বড় যে প্রভাব পড়ে সেটা হচ্ছে বাচ্চার চোখের ওপর। এখন তো আমরা দেখি অনেক বাচ্চাদের খুব অল্প বয়সের চশমা ব্যবহার করতে হয়। মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্রেইনের ওপর চাপ পড়তেছে। সব মিলে এই ডিভাইস আসক্তি একটা বাচ্চার জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। একটা সময় এ ধরনের ডিভাইস আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসা অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে।

খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক, বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার মাধ্যমে ডিভাইস আসক্ত দূর করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

টিএই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর