বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের বয়সন্ধিঃকালে সহায়তার আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের বয়সন্ধিঃকালে সহায়তার আহ্বান

দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা উঠতি প্রজন্মের নারীদের বয়সন্ধিঃকালের বিষয়ে আগাম ও ব্যাপক পরিসরে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারকর্মীর। এ লক্ষ্যে শুধু নারীদের নিয়ে নিরাপদ ও আন্তঃসহযোগিতামূলক বৈঠকের সুপারিশ করেছেন তারা।

শনিবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আয়োজনে (বিএইচডব্লিউ) ‘দ্য এমারজিং চ্যালেঞ্জেস টু সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (এসআরএইচআর) ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দিনব্যাপী সম্মেলনে এই আহ্বান জানানো হয়।


বিজ্ঞাপন


দুই ধাপে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর এসআরএইচআর নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে দ্য পপুলেশন কাউন্সিলের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহযোগী জুডিথ ব্রুস অগ্রাধিকার দিতে হবে এমন বেশ কিছু বিষয়ে কথা বলেন। এর মধ্যে সবার আগে তিনি দারিদ্র্য ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা উঠতি প্রজন্মের নারী বয়সন্ধিঃকালে আগাম ও ব্যাপক পরিসরে সহায়তা দেওয়ার কথা বলেন। এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি শুধু নারীদের নিয়ে বৈঠকের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন। তার মতে, নিরাপদ অন্তঃসহযোগিতামূলক এ বৈঠকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ে নারীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাগাভাগি করতে পারবেন। এমনকি পরিবারের বড়-ছোট সব সদস্যকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে পারবেন। তিনি আর্থিক বিষয়ে সচেতনতা ও বাজার উপযোগী দক্ষতা যা তাদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে সেগুলো নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, প্রধান মূল্যবোধগুলো বিবেচনায় যারা মানবাধিকার বিষয়ক নীতি প্রণয়ন করেন তাতে কোথায়, কাকে ও কখন প্রজনন এবং যৌনস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ নিয়ে সর্বোচ্চ ফল পাওয়ার বিষয়ে পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা থাকে না। এইভাবে সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপিত বিশ্লেষণ ও প্রমাণাদি সেবা নিয়ে দুর্বলতা তুলে ধরে। ফলে এসব বিশ্লেষণ ও প্রমাণাদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও এতে প্রযুক্তির যথোপোযুক্ত ব্যবহার হচ্ছে না। আর সর্বোচ্চ ঝঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা ও দিকনির্দেশনা দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্র্যাকের কমিউনিটি পর্যায়ের চুক্তির কথা স্মরণ করে তিনি তাঁর পযবেক্ষণ তুলে ধরে আরও বলেন, এই ধরনের অধিকারগুলোর সঙ্গে যুক্ত ও দায়বদ্ধ কমিউনিটির ভেতর প্রস্তুত থাকা নারী অন্য কাউকেই সুরক্ষা দেয় না।

w2


বিজ্ঞাপন


আলোচনায় অংশ নিয়ে জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের খন্ডকালীন অধ্যাপক তাসনিম আজিম তার উপস্থাপনায় ব্যাখ্যা করে বলেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, পরস্পরের অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত এবং যৌনবাহিত রোগ (এসটিআই) এর দুটোকেই প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে এসটিআই বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত খুবই কম এবং এসটিআই বিষয়টিকে উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে করে অতিরিক্ত বা কম অপর্যাপ্ত চিকিৎসায় ভুল রোগ নির্ণয় করা হয়ে যেতে পারে। পরীক্ষাও চিকিৎসা  ব্যবস্থা উন্নত করা এবং যৌন স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এমন কাঠামোগত ও সামাজিক বাধাগুলো মোকাবিলা করা বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

দ্য পপুলেশন কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ সহযোগী সাজেদা আমিন তার ‘দ্য পাথওয়ে অব ক্লাইমেট চেঞ্জ ইমপ্যাক্ট অন এসআরএইচআর’ শীর্ষক উপস্থাপনায় জলবায়ু পরিবর্তন যে নানাভাবে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার এবং ন্যায়বিচারের (এসআরএইচআরজে) ক্ষেত্রে নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে সে বিষয়টি তুলে ধরেন। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ায় মাতৃস্বাস্থ্য উচ্চ ঝুঁকিতে পড়ছে। যেটাকে একলাম্পসিয়া ও প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি বলা হয়। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের উচ্চ ঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতার উচ্চ ঝুঁকি আছে। শহরের বস্তিগুলোর বাসিন্দাদের বাস্তূচ্যুতির ফলেএসব ঝুঁকি যৌন সহিংসতা ও অধিকার লঙ্ঘনের দিকে সমাজকে ঠেলে দিতে পারে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন ‘নোয়িং অ্যান্ড ইউজিং দ্য ল টু শেপ উইমেনস অ্যান্ড গার্লস রাইট টু হেলথ’ শীর্ষক তাঁর উপস্থাপনায় দেখান, এখনও এমন কিছু আইন আছে যা নারীর অধিকার ও সমতার প্রতি বৈষম্যপূর্ণ। এসব আইনের কারণে নারীরা স্বাধীনভাবে এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না যেসব সিদ্ধান্ত তাঁদের জীবনকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বিয়ে, জন্মনিরোধক বা প্রজনন স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করেন। এ ছাড়া পেশা ও  শ্রেণির জন্য নারীরা বৈষম্যের শিকার হয় জানিয়ে বাল্যবিয়েও বাংলাদেশের মেয়েদের অধিকারে নাটকীয় প্রভাব ফেলছে বলে জানান তিনি।

বিএইচডব্লিউ-এর অ্যাডভাইজরি গ্রুপের প্রধান রওনক জাহান গত শতকের সত্তর ও আশির দশকের শুরুতে নারী ও মেয়েদের অধিকার, তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে প্রখ্যাত হয়ে ওঠা অ্যাড্রিয়েন সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, অ্যাড্রিয়েন নারীর অধিকার ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেছেন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকল্প ও কর্মসূচির জন্য তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে সহায়তা করেছেন। এসব প্রকল্প ও কর্মসূচি মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে কাজ করেছে। মাসিক নিয়ে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত কর্মসূচির অন্যতম সমর্থক ছিলেন অ্যাড্রিয়েন। স্বাস্থ্যখাতের কর্মসূচি ও নীতিনির্ধারণে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার (এসআরএইচআর) ধারণা দিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন। কায়রোতে ১৯৯৪ সালে এসআরএইচআর-কে স্বীকৃতি দেয় আইসিপিডি।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এই সম্মেলনটি আড্রিয়ানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আয়োজন করেছে, কারণ অ্যাড্রিয়েন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নীতি ও কর্মসূচিতে এসআরএইচআর এর বিষয়টি যুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । সম্মেলনে যেসব গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল তাঁর সবগুলোতেই আমরা দেখছি নারীর স্বাস্থ্য নির্ভর করে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর।

w3

এ সময় তিনি গবেষণায় নারীরা যেসব বাঁধার কারণে পিছিয়ে পড়েছে এর জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেন, যাতে করে নারীরা তাদের সমঅধিকারের বিষয়ে সচেতন হতে পারেন এবং পুরুষের সমান সুযোগ সুবিধা পান।

এদিকে এদিন সম্মেলনে মোট তিনটি গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক কাওসার আফসানা ‘উইমেন অ্যাট দ্য মার্জিন: দ্য রিডাকশনিস্ট অ্যাপ্রোচ টু ম্যাটারনাল হেলথ’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি তুলে ধরেন, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে মাতৃমৃত্যু হার কমছে। তবে সামাজিক নির্ধারক এই বিষয়টি আরও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। সমাজে নারীর অবস্থানের কারণে নারীরা কীভাবে মাতৃমৃত্যু ও নানা রোগের বড় ভুক্তভোগী সেসব বিষয় নিয়ে প্রমাণাদি তুলে ধরেন এই অধ্যাপক।

জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ও অধ্যাপক সাবিনা ফয়েজ রশিদ ‘ফল্ট লাইনস ইন পাবলিক হেলথ: ইয়াং উইমেনস লাইভস ইন ঢাকা’স বস্তি’ বিষয়ে বক্তব্য দেন।  তিনি বলেন, ‘বস্তিতে বসবাসকারী তরুণীদের জন্য প্রাসঙ্গিক কর্মসূচি ও নীতি প্রণয়নে লিঙ্গ, যৌনতা ও স্বাস্থ্যের মানবিক মাত্রা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। শরীরের ভেতর যে ‘রোগ’ বাসা বেঁধেছে তা দূর করার জন্য একটি বহুমাত্রিক চোখ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের নৃতাত্ত্বিক সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা জরুরি। একই সঙ্গে একজনের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য দারিদ্র্য, বয়স, লিঙ্গ, যৌনতা, পরিবেশ, ক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনায় একটি সামগ্রিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারবেন।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের জ্যেষ্ঠ সহযোগী হালিদা হানুম আখতার এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপ্টিক অ্যাবরশন, বাংলাদেশের (বাপসা) নির্বাহী পরিচালক আলতাফ হোসেন ‘দ্য বাংলাদেশ এমআর-এমআরএম প্রোগ্রাম: সাকসেস, চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক তাঁদের উপস্থাপনায় বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি ৩ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের নারীদের অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ও নারীর জীবনে এর পরিণতির বিষয়টি কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি ভালো মাসিক নিয়ন্ত্রণ (এমআর) কর্মসূচি, গর্ভপাত পরবর্তী যত্ন (পিএসি) পরিষেবা, জরুরি গর্ভনিরোধক বড়ি ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আছে। ২০১৪ সালে নারীদের জন্য জাতীয় কর্মসূচিতে এমআরএম (মেডিকেল এমআর) বিষয়টি যুক্ত করতে হয়। এতে করে নারীরা তাঁদের পছন্দের উপায় বেছে নিতে পারেন। যদিও সঠিকভাবে বিতরণ না  হওয়ার কারণে এতে করে আরও বেশি জটিলতা তৈরি হচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন পেশার মানুষ, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধ এবং গণমাধ্যমকর্মীরা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বাংলাদেশে এসআরএইচআর বিষয়ে উন্নতি ও সমস্যা সমাধানে নানা রকমের পরামর্শ দেন সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা।

এমএইচ/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর