শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

এক সেলাই মেশিন থেকে ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ জয়িতা পলি

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২২, ১১:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

এক সেলাই মেশিন থেকে ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ জয়িতা পলি
এক সেলাই মেশিন থেকে ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ জয়িতা পলি | ছবি: ঢাকা মেইল

বেসরকারি এক সংস্থা থেকে জয়িতা পলি পেয়েছিলেন চারদিনের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে দেওয়া হয় একটি সেলাই মেশিনসহ নগদ আট হাজার টাকা। যা দিয়ে প্রথমে ১৭ জন নারী সহকর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে তার ‘ডিএ ফ্যাশন হাউজ’। যা আজ অধিকার হারা প্রায় সাড়ে চারশত নারীর কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছে। যে প্রতিষ্ঠান থেকে তার আয় প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা।

প্রান্তিক নারী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কাছে আশার আলোয় পরিণত হয়েছেন পলি। পরিশ্রম, আগ্রহী এবং অদম্য এ সফল উদ্যোক্তা নিজেকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবেই লৈঙ্গিক পরিচয় দিয়ে থাকেন।


বিজ্ঞাপন


তবে তার এই পথচলার শুরুটা মসৃণ ছিল না। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা, আগ্রহ ও পরিশ্রম তাকে আজ সফলতার পথ তৈরি করে দিয়েছে। তার হাতে গড়ে উঠা ‘ডিএ ফ্যাশন হাউজ’ তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের হাতের তৈরি শাড়ি, থ্রি-পিস, বেডশিট ও কুশন কভার। যা দেশে সুনাম অর্জনের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সামাজিক প্রেক্ষাপট রক্ষণশীল নীতির ফলে বারবারই তার থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নচারী থেমে থাকেননি। দেখেছেন দিক বিজয়ের। নিজ সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করার। তার মূল পুঁজি ছিল- সততা, পরিশ্রমই আর আত্মবিশ্বাস। ফলে পলি আজ তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ও নারীদের অনুপ্রেরণা।

বর্তমানে তিনি নিজ কমিউনিটি (হিজড়া) জন্য কাজ করছেন। এছাড়াও সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য কাজ করছেন পলি। নিজ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছেন ‘জয়িতা পুরস্কার’, ২০১৮ সালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে Woman of the World (WoW) ওয়াও পুরস্কার, ২০১৯ সালে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি থেকে ‘Humanitarian Award’ বা ‘মানবিক পুরস্কার’ লাভ করেন পলি।

এছাড়াও, ২০২০ সালে এসএমই পণ্যমেলা থেকে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা’ হিসেবে পুরস্কৃত হন তিনি। আর ২০২১ সালে রাজশাহী জেলার হিজড়া সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’- এর পক্ষ থেকে জয়িতা পলি ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ পান এই উদ্যোক্তা।


বিজ্ঞাপন


বর্তমানে ব্যবসাসহ সামাজিক কাজে দারুণ ব্যস্ত সময় পার করছেন পলি। নিজ জেলা রাজশাহীতে এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচি নিয়েও কাজ করেন। স্থানীয় নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়ে থাকেন ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘকে’ সঙ্গে নিয়ে। যার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেকেই।

নিজ কাজে দৃঢ় জয়িতা পলি তার বর্তমান কাজ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা মেইলের সঙ্গে। শুনিয়েছেন তার সংগ্রামের গল্প।

পলি জানান, স্বাভাবিক দুই একটা সন্তানের মতোই আমার জন্ম। জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। বয়স যখন ৬/৭ বছর, শারীরিকভাবে ছেলে ছিলাম কিন্তু মানসিকভাবে নিজেকে নারী ভাবতাম। এই ভাবনাটা আমার পরিবার সহজেই মেনে নেয়নি। একসময় আমার মা মেনে নিলেও বাবা মেনে নেওয়া তো পরের কথা কখনও সহ্য করতেও পারতেন না। অবহেলা, অবজ্ঞার চোখে দেখতেন সবসময়।

সপ্তম শ্রেণিতে উঠার পর নিজের ভেতরে নারী সত্তাটা আরও বেশি কাজ করতে শুরু করে জানিয়ে পলি বলেন, একপর্যায়ে স্কুল থেকে আমাকে বের করে দেয়। পড়াশোনা বন্ধ। বাসায় থাকলাম ১-২ বছর। চেষ্টা কিংবা আশা কখনোই ছাড়িনি। এরপর আবারও স্কুলে ভর্তি হলাম। বাবা শুরু থেকেই পড়াশোনার খরচ দিতেন না। মা সংসারের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠাতেন। যখন দশম শ্রেণিতে উঠলাম, স্কুল থেকে বলা হলো- পরীক্ষার সময় শুধু স্কুলে আসবে। ক্লাস বন্ধ। তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।

২০০৬ সাল (১০ম শ্রেণি) নয়’শ টাকা লাগবে ফর্মফিলাপ করতে। বাবা দেবে না। একপর্যায়ে বাসায় যত মুরগি ছিল মা সব বিক্রি করে দিলো। কোনোমতে ফর্মফিলাপ করলাম। এরপর পরীক্ষা আসলো। মনে পড়ে, পরীক্ষা দিতে মাত্র দুই দিন গাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তারপর আর ভাড়ার টাকা নাই। যেদিন পরীক্ষা খুব সকালে উঠতাম। সকাল ৬ টায়। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছাইতাম পরীক্ষা কেন্দ্রে। আবার এই ১১-১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে ফিরে আসতাম বাসায়। এসএসসি পাশ করার পর বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিলো।

পলি জানান, আত্মীয়-স্বজনদের কেউই আমাকে নিতে চাইলো না। চলে আসি হিজড়া সম্প্রদায়ের যিনি গুরুমা ছিলেন ওনার কাছে। গুরুমাকে বললাম, আপনার বাসার সমস্ত কাজ আমি করব। কিন্তু আমাকে একটু পড়াশোনার সুযোগ দিতে হবে। তিনি রাজী হলেন।

আমি ২০১৪ সালে ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ থেকে চার দিনের একটা ট্রেনিং পাই। সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু। প্রথমে ১৭ জন নারী সহকর্মী নিয়ে কাজ শুরু করি ‘ডিএ ফ্যাশন হাউজ’। সমাজে যারা অবহেলিত নারী তাদের হাতের কাজ শেখাই। ১৭ জন থেকে এখন আমার এখানে প্রায় সাড়ে চারশত নারী কাজ করে। যাদের অনেকেই হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডার।

আরও পড়ুন: পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার চান বিএনপিএস

পেছন থেকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি জনিয়ে তিনি বলেন, আমা ভেতরে একটা লক্ষ্য ছিল। উদ্দেশ্য ছিল। সেটাকে অরও স্পিড এবং শক্তিতে পরিণত করেছে তারা। এতকিছুর পরও আমার বাবার যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল, তিনটা গাড়ি ছিল সবকিছু ভাইকে দিয়ে দেয়।

সফল হওয়ার পর পরিবারে নিজের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাইকে সম্পত্তির সবকিছু দেওয়ার পরে আমাকে পরিবার ডেকেছে। এখন পরিবারের সাথেই থাকি। একটা জিনিস দেখি এখন, আমি যদি একটু অসুস্থ হয়ে যাই বাবা পাগল হয়ে যায়। আমার সেবাযত্ন বাবাই এখন করেন। আমার মন যদি একটু খারাপ হয়, বাবা বারবার আসে। জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা কিনা। বর্তমানে পরিবারের সমস্ত সিদ্ধান্ত আমার ওপরে। যে আত্মীয়-স্বজন একদিনের জন্য আমাকে তাদের বাসায় জায়গা দেয়নি, তারা এখন মাঝে মাঝেই দাওয়াত দেয়। আমার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়। সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি।

ডিএইচডি/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর