মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নির্যাতনে শিশু-কিশোরদের সুস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে: গবেষণা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

নির্যাতনে শিশু-কিশোরদের সুস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে: গবেষণা

ঘরে-বাইরে নির্যাতনের কারণে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার তাদের সুস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। নির্যাতনের কারণে উচ্চ রক্তচাপ ও স্থূলতা বাড়ছে। এসব কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়ছে বলে গবেষণার ফলে বলা হয়েছে।

শিশু অধিকার এবং সুরক্ষা, অনলাইনে শিশু নির্যাতন, শৈশবের বিরুপ অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যা, শিশু নির্যাতন বন্ধে মিডিয়ার ভূমিকা ও অসংক্রামক রোগ: শিশু বিকাশের অন্তরায় বিষয়ে গবেষণার প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।


বিজ্ঞাপন


বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউয়ে ‘শিশু স্বাস্থ্য, বিকাশ ও সুরক্ষা' শীর্ষক ডেসিমেনেশন অনুষ্ঠানে গত পাঁচ বছরে শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

বিশ্ব শিশু দিবস-২০২২ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ)' ‘শিশু স্বাস্থ্য, বিকাশ ও সুরক্ষা' শীর্ষক পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিভেন্টিভ এন্ড সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদের ডিন ও পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ শরিফুল ইসলাম।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ ১৬.২ শতাংশ, যার মধ্যে ছেলে বেশি। বেশি সময় বসে থাকা, স্থূলতা এবং শারীরিক পরিশ্রম না করাকে ঝুঁকির কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে। কোভিড মহামারী চলাকালীন ২০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী বিভিন্ন মাত্রার অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়েছিল, যার মাঝে যথাক্রমে ১৮ শতাংশ, ১৪ শতাংশ এবং ১৬ শতাংশের বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তা ছিল।


বিজ্ঞাপন


অনুষ্ঠানে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মকর্তা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে শিশুস্বাস্থ্য, বিকাশ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রকল্প এবং একাডেমিক গবেষণা উপস্থাপন করা হয়।

অনুষ্ঠানে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ বিগত পাঁচ বছরের ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠীর ওপর গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিশ্বজুড়ে শিশু নির্যাতন জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি উদ্বেগজনক ঘটনা এবং শিশু বিকাশের জন্য একটি বড় বাধা হিসাবে স্বীকৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শিশু নির্যাতন বলতে সব ধরনের শারীরিক এবং/অথবা মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অবহেলা, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য নির্যাতনকে বোঝায়, যার ফলে দায়িত্ববোধ, বিশ্বাস বা আত্মমর্যাদার প্রেক্ষাপটে শিশুর স্বাস্থ্য, বেঁচে থাকা এবং বিকাশের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের কোনো স্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। 

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, ঢাকা শহরের টারশিয়ারী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অটিজমে আক্রান্ত ৪৫ জন শিশুর মায়েরা জানিয়েছেন ৩ থেকে ৯ বছর শিশুর প্রত্যেকেই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মাঝে ৮.৯% কোনও না কোন সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় ১৪১৬ জন ১১-১৭ বছর বয়সী শিশুর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, (ছেলে/মেয়ে এবং নির্বিশেষে), বাড়িতে, স্কুলে এবং কর্মক্ষেত্রে ১৯% শারীরিক নির্যাতন, ১৭% মানসিক নির্যাতন এবং ৭৮% অবহেলার শিকার হয়।

অন্যদিকে ঢাকা শহরের বস্তি এলাকা পরিচালিত অন্য একটি গবষেণায় ৩৮৪ জন বাবা-মায়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখা যায়, শিশু (৭-১৭ বছর বয়সী) তার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৬.১%, মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৪.৭% এবং অবহেলার শিকার হয়েছে ২১.১%।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, যে কর্মজীবী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু এবং বস্তি এলাকায় বসবাসকারী শিশুরা অত্যাচারের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে।

সিরাজগঞ্জ জেলার চারটি বাজারের ৩৯৮ জন কর্মজীবী শিশুর ওপর পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশুরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ১০০ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় ১০০% এবং অবহেলার শিকার হয় ৮২.৭%।

২০১৭ সালে পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় ১৪১৮ জন বাবা- মায়ের সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, প্রায় ৯২% শিশু গবেষণা পূর্ববর্তী এক বছরে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং ৯৪% শিশু তাদের শৈশবের যেকোনো এক সময়ে বাবা-মার কাছে থেকে নিয়ম-কানুন শেখার জন্য নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।

এদিকে ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী ২৪ জন শিশুর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশু নির্যাতন সামাজিকভাবে স্বীকৃত একটি গতানুগতিক এবং কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা যার মারাত্মক শারীরিক এবং মানসিক প্রতিক্রিয়া আছে।

এতে বলা হয়, বিশেষত কমবয়সী শিশু, মেয়ে-শিশু এবং গরিব শিশু তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিতে থাকে। পরিবার, খোলা এবং কর্মক্ষেত্রে তারা নিম্নস্তরে এবং নিম্ন অবস্থানে থাকায় তাদের কথায় গুরত্ব দেওয়া হয় না।

গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতা অর্থাৎ শিশুর ১৮ বছর বয়সের আগে ঘটে যাওয়া আঘাতমূলক এবং পীড়াদায়ক ঘটনা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সামগ্রিক শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে দ্বিগুণ করে।

গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, যেসব মায়েরা তিন বা ততধিক প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন, তাদের মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা সম্পন্ন শিশু জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা চারগুণ বেশি।

অন্য একটি গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্কদের বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার সঙ্গে প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতার একটি উল্লেখযোগ্য যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

এছাড়াও বেশি প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতার জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। যেসব মহিলা বেশি প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে স্বামীর দ্বারা সহিংসতার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এসময় বাংলাদেশে শিশুদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারকে অবশ্যই জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন বক্তারা।

শিশু নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুদের প্রতিরোধমূলক কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং কঠোর নিয়ম-কানুন প্রয়োগের মাধ্যমেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদকে মেনে চলতে পারে বলেও মনে করেন বক্তারা।

বিইউ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর