শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

একা নারী পর্যটক বাড়ছে, কী অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন তারা?

সাকিব আবদুল্লাহ
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২২, ১০:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

একা নারী পর্যটক বাড়ছে, কী অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন তারা?
একা নারী পর্যটক বাড়ছে | ছবি: সংগৃহীত

শ্রাবণী তন্বী সম্প্রতি স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেছেন। তিনি ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে ঘুরতে গিয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। এখন পর্যন্ত ২৫টির বেশি ট্যুরে গিয়েছেন। একা নারী হিসেবে ঘুরতে গিয়েও তিনি কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো অভিজ্ঞতা নিয়েই ফিরেছেন।

শ্রাবণী ঢাকা মেইলকে বলেন, যখন কোনো বান্ধবী-বন্ধু থাকে না, তখন একাই ট্যুরে যাই। যে অপারেটর বা এজেন্সির মাধ্যমে যাই, তাদের জিজ্ঞেস করি, একা যাওয়া যাবে কিনা, কোনো সমস্যা আছে কিনা, নিরাপত্তার ব্যাপারটা কেমন- এসব। তারাই সেফটির নিশ্চয়তা দেয়। একা মেয়ে গেলে অপারেটররাও নিষেধ করে না। যত জায়গায় গিয়েছি প্রায় সবই চমৎকার ছিল। থাকার ব্যবস্থা নির্ভর করে ট্যুরের জায়গার ওপর। যখন আমি ট্রেকিংয়ে গিয়েছি পাহাড়ে, তখন আদিবাসীদের বাড়িতে থেকেছি। দেখা গেছে, ১০ থেকে ১৫ জন মিলে একরুমে ছিলাম। একপাশে ছেলেরা থাকে, অন্যপাশে মেয়েরা থাকে। এমন অবস্থায় কোনো বাজে অভিজ্ঞতা আমার হয়নি, আমি দেখিও নি।


বিজ্ঞাপন


প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক তানিয়াহ মাহমুদা তিন্নির ভাবনাটাও একইরকম। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি সবসময় ভাবি- মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। এক গ্রুপে যখন একসঙ্গে ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষ থাকবে, তখন সেটা আমার জন্য অপেক্ষাকৃত সেইফ হবে। সেখানে দু-একজন বাজে লোকও থাকতে পারে, কিন্তু সবাই তো এমন হবে না। বিপদে পড়লে হেল্প পাওয়া যাবে। আমি দেশেও ট্যুরে গিয়েছি, বাইরেও গিয়েছি।

সম্প্রতি সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম। দুইজন মেয়ের সঙ্গে, তখন থাকতাম চট্টগ্রামে। তখন একটা গ্রুপের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অপারেটরটা ছিল ঢাকার। তারা ঢাকা থেকে রওনা দেয়, আমরা চট্টগ্রাম থেকে যুক্ত হই। তারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। আর সেখানেই সবই অপরিচিত মানুষ ছিল। কিন্তু কোনো আনকমফোর্টের ব্যাপার ছিল না।

ট্যুর অপারেটররা নারীদের কেমন খেয়াল রাখেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনিভার্সাল ট্যুর গ্রুপের ফাউন্ডার অ্যাডমিন তাপস কুমার সাহা জানালেন, তারা নারীদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের সঙ্গে যদি কোনো একা আপু যায়, তাহলে আমি তাকে সবসময় নিজের বোনের মতো দেখাশোনা করি, চোখে চোখে রাখি। সে কোথায় যাচ্ছে, তার সঙ্গে কেউ বাজে আচরণ করছে কিনা। তাছাড়া আমি তাদের জিজ্ঞেসও করি, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। আর কাউকে না বলতে পারলেও আমাকে যেন জানায়। আমার সঙ্গে সিঙ্গেল আপু, ভাইয়া সবাই যায়। আর নিরাপত্তার বিষয়ে যদি বলি- যেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে, সেখানে আমি গ্রুপ নিয়ে যাই-ই না। যেহেতু সঙ্গে নারীরা থাকে, তাই নিরাপত্তার বিষয় আসে সবার আগে।

বাজে অভিজ্ঞতার প্রশ্নে তানিয়াহ তিন্নি বলেন, আমি ভারতে ছিলাম কয়েক বছর। তখনও ঘুরতে গিয়েছি বিভিন্ন জায়গায়। একবার হিমাচলে গেলাম। তখন কোনো অপারেটরের মাধ্যমে যাইনি। আমি থাকতাম দিল্লিতে। কয়েকজন মিলে গেলাম। বড় গ্রুপ না হলে আসলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। যেমন ধরেন- একটা জীপে ১০ থেকে ১২ জন যেতে পারে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আছেই চারজন। এখন আমার তো পুরো গাড়িটাই নিতে হচ্ছে। তো ওখানে কয়েকটা ছেলের একটা গ্রুপও ঘুরতে গিয়েছিল। ওখানে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা আভাসে ইঙ্গিতে হ্যারাস করার চেষ্টা করে, নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলছিল। পরে আমরা আর ওদের সঙ্গে ঘুরিনি। এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে, নারীদের একেবারে একা না গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে গেলে ভালো। আর ভালো প্রতিষ্ঠিত ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমেই যাওয়া উচিত।


বিজ্ঞাপন


এ প্রসঙ্গে শ্রাবণী বলেন, ট্যুর তো অনেকদিন ধরে করছি। একটা জায়গায় কিছুটা বাজে এক্সপেরিয়েন্স ছিল। ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে একবার গেলাম রেমাক্রিতে। ফেরার সময় নৌকায় আমরা দুইজন মেয়ে ছিলাম একসঙ্গে, ট্যুর গ্রুপের অ্যাডমিনও ছিল। একসময় তিনি আমাদের ডাকলেন, এদিকে আসো, এদিকে আসো। যাওয়ার পর তিনি হাতে পানি নিয়ে এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে আমাদের পিঠের ওপর ফেলতে লাগলেন, সঙ্গে বলছিলেন, ফিলিং গুড, ফিলিং গুড। এটা আমার কাছে খুব বাজে লেগেছিল। ঢাকায় ফেরার পরে এই লোক ম্যাসেঞ্জারেও বিরক্ত করছিল। আরেকবার এক ট্যুর গ্রুপের অ্যাডমিন বাসে হুট করে আমার পাশে বসলো। বসার পর বোঝাই যাচ্ছিল তার উদ্দেশ্য ভালো না। পরে বিরতির সময় আমি আরেকজনকে ডেকে আমার পাশে বসাই। আলিকদম থেকে চকরিয়ায় আসার সময় এইটা ঘটে।

শ্রাবণী এমন ট্যুরেও গিয়েছেন যেখানে তিনি একাই শুধু মেয়ে ছিলেন। কেমন লেগেছে সেখানে- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফ্রেন্ডদের সঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও দেখা গেলো সময় মিলে নাই। তাই পরে একাই গিয়েছি। তবে যাদের সঙ্গে গিয়েছি তারা মোটামুটি চেনাজানাই ছিল। একবারের কথা বলি, সেবার রাঙামাটি গেলাম। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়র মিলে ছেলে ছিল ৭ থেকে ৮ জন, মেয়ে আমি একাই। সেখানেও কোনো অস্বস্তি বোধ করিনি। আরেকবার কক্সবাজারেও গেলাম এমন ট্যুরে। রাতে বিচে যাচ্ছি, শাড়ি পড়া, হাতে ক্যামেরা। স্থানীয় কয়েকজন দেখলাম একটু বাজে ভাবে তাকাচ্ছে, কথা বলার চেষ্টা করছে। তখন আমার ট্যুরের সঙ্গীরাই কিন্তু আমার পাশে ছিল, ওরাই আমার কমফোর্ট জোন নিশ্চিত করেছে।

তার মতে, জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলোর মানুষ বেশি সহনশীল এবং হেল্পফুল। একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে শ্রাবণী পুরুষতান্ত্রিক ইগোর শিকারও হয়েছেন। তিনি বলেন, একটা প্রজেক্টের কাজে দুইজন ছেলের সঙ্গে আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়েছিলাম। বিকালে যখন আশেপাশে ঘুরতে গিয়েছি, তখন দেখি লোকজন বাজেভাবে তাকাচ্ছে, হাসাহাসি করছে। এমনকি ওখানকার লোকাল মেয়েরাও এমন বিহেভ করছে। ওখানে এক দোকান চা-পুরি খেতে গেলাম। আমি বললাম, মামা চা-পুরি দিয়েন। এতে ওই দোকানদার খুবই বিরক্ত হচ্ছিল। যেন একটা মেয়ে মানুষ কেন অর্ডার করবে! ছ্যাঁত ছ্যাঁত করছিল। আসলে ওই জায়গা তো কোনো জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট না, ওখানকার মানুষ মেয়েদের এমনভাবে ঘুরতে দেখতে অভ্যস্তও না। তাই এই প্রবলেমগুলো হচ্ছিল। আমি দেখেছি, যেগুলো জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট সেখানকার লোকাল মানুষ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক সহনশীল।

ট্যুর অপারেটররা নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন তানিয়াহ তিন্নি। তিনি বলেন, দেশে এখন কয়েকটা বড় গ্রুপ আছে ট্যুরের, তারা বেশ ভালো কাজ করছে। এগুলোর মাধ্যমে অনেক মেয়েরাই যাচ্ছে। আর যাওয়ার আগে অবশ্যই খোঁজ-খবর করে যেতেই হবে। ট্যুর অপারেটরদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এতে টুরিস্টদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাছাড়া ট্যুরে যদি হ্যারাসমেন্টের ঘটনা ঘটে তাহলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর গলিতে গলিতে ট্যুর অপারেটর গড়ে ওঠার সংস্কৃতি ভালো নয়। তাদের প্রোপার জনবল, অফিস এবং ম্যানেজমেন্ট থাকা উচিত। তারা যাদের নিয়ে যাচ্ছে, তাদের লিস্ট ও ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করা উচিত। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। এসব করলে শুধু নারীর জন্য না, সবার জন্যই ট্যুর করা নিরাপদ হবে।

এ প্রসঙ্গে ট্যুর অপারেটর তাপস বলেন, গত কয়েক বছরে একা একা নারীদের ট্যুরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একবার গাজীপুরের ছয় মেয়ে আমার সঙ্গে সিলেটে গেছিল। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদা আপনার সঙ্গে কেন যাব। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার ২৫ মিনিট লেগেছিল। পরে তারা ঘুরে এসে বলেছে, দাদা কোনো সমস্যা হয় নাই। আরেকটা জিনিস, মেয়েরা যখন একা একা ট্যুরে যান, আমি তাদের জিজ্ঞেস করি তারা বাসায় জানিয়ে এসেছেন কিনা, কাদের সঙ্গে যাচ্ছেন সব বলে এসেছেন কিনা। এমন পরিস্থিতিতে দেখেছি, ৫০ শতাংশ মেয়ে বাসায় তেমন কিছু না জানিয়েই ঘুরতে এসেছেন। আমার মনে হয় সবারই আসলে জানিয়ে আসা উচিত।

ট্যুরে যাওয়ার আগে নারীদের কীভাবে অপারেটর বা এজেন্সি বেছে নেওয়া উচিত সে বিষয়ে কথা বলেন শ্রাবণী। তিনি জানালেন, পরিচিত ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। বা পরিচিত কেউ যদি কোনো অপারেটরকে রেফার করে- সেখানেও যাওয়া যায়। আমি এভাবেও গিয়েছি। আবার একদম অপরিচিত অপারেটরদের সঙ্গে যাওয়ার আগে ভালো করে খোঁজ নিয়ে গিয়েছি। এখন এদের ফেসবুক পেজ থাকে, গ্রুপ থাকে। সেখানে তাদের কার্যক্রমের ডিটেল থাকে। তারা কতদিন থেকে কাজ করছে, তাদের পোস্টগুলোর নিচে কমেন্টে মানুষের ফিডব্যাক কেমন এগুলো দেখেছি। গ্রুপের অ্যাডমিনদের আইডি পাবলিক করা থাকলে তাদের পোস্টগুলো দেখেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি তারা মানুষ হিসেবে কেমন। আবার যাওয়ার আগে অ্যাডমিনদের সঙ্গে কথাও বলি। যদি দেখা যায়, ভালো মনে হয় তাহলে যাই। আসলে অপরিচিত ছোট গ্রুপ যাদের কার্যক্রম কম তাদের ওপর ভরসা করা মেয়েদের জন্য টাফ। আর যাদের সঙ্গে যাচ্ছি তাদের নম্বর-ঠিকানা সব বাসায় দিয়ে যাই। অনেকসময় তাদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে সেগুলোর স্ক্রিনশটও তুলে রাখি। ভবিষ্যতে বিপদে পড়লে এগুলো কিছুটা প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিইএ) চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, অপারেটরদের মাধ্যমে গেলে- এগুলোর রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা, অফিস আছে কিনা, নিদেনপক্ষে ট্রেড লাইসেন্স আছে কিনা তা দেখে যেতে হবে। হুট করে ফেসবুক গ্রুপ বা চিপাচাপার গ্রুপের সঙ্গে গেলে এই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন। সেখানে সার্ভিসে কোনো সমস্যা হলে বা হ্যারাসমেন্টের শিকার হলে প্রতিকার পাওয়াও কঠিন হয়। কিন্তু রেজিস্ট্রার্ড অপারেটর বা এজেন্সির মাধ্যমে গেলে অভিযোগ প্রদান ও প্রতিকার সবই সহজে করা যাবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া অপারেটর আছে সাড়ে চার হাজার। আর শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে কাজ করে এমন অপারেটরের সংখ্যা আরও তিন হাজার।

বিটিইএ চেয়ারম্যান শহিদুল বলেন, সারাবিশ্বেই নারীরা এখন সলো ট্রাভেল করে। এখন বাংলাদেশেও এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। তারা যদি অপারেটরদের মাধ্যমে না গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যান, তাহলে তাদের উচিত জেলা পরিষদের ডাকবাংলো বা পর্যটন করপোরেশনের মোটেলে থাকা। এগুলো সম্পূর্ণ নিরাপদ। দেশের প্রেক্ষাপটে র‍্যান্ডম যে কোনো হোটেল এখনও একা নারীদের জন্য নিরাপদ না। আর যেখানে যাচ্ছেন, সেখানের অবস্থা ও রুট সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ-খবর করে যাওয়া উচিত।

এসএ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর