শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

জীবন সংগ্রামে অদম্য ‘ময়না দিদি’

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২২, ১০:২৮ পিএম

শেয়ার করুন:

জীবন সংগ্রামে অদম্য ‘ময়না দিদি’
প্রতিবেশীরা সবাই তাকে ময়না দিদি বলেই ডাকেন | ছবি: ঢাকা মেইল

মায়ের রাখা নাম মুনি রাণী শাহ্ (৪৫)। যদিও পাড়ার সবাই ময়না দিদি বলেই ডাকেন। অভাবের সংসারে বেড়ে উঠা। পরিণত বয়সে ময়না সংসার বাঁধেন মলয় শাহ্’র সঙ্গে। স্বামীর ভিটেমাটি না থাকায় আশ্রয় মেলে বাবার বাড়ি। পেশায় মলয় শাহ হালিম বিক্রেতা। নগরীর মোড়ে ভ্যানে ঘুরে ঘুরেই সেই হালিম বিক্রি করতেন। যা সাজিয়ে দিতেন ময়না নিজেই।

অভাবের সংসারে দুজনের স্বপ্ন- স্থায়ী হালিমের দোকান সাজানোর। বছর দশেক আগে পাড়ার গলিতে দোকানও নেন। চলছিলও বেশ। মলয় নিজে দোকান চালালেও পরিচিতি মিলে ময়না দিদির দোকান নামেই। যে দোকানের হালিমের স্বাদ এখনও অনেকের মুখে মুখে।


বিজ্ঞাপন


একপর্যায়ে মলয়-ময়না দম্পতির স্বপ্নে পরিণত হয় খাবারের হোটেল দেওয়ার। যে কথা সেই কাজ। গলির ভেতরের দোকান ছেড়ে রাজধানীর পশ্চিম মেরুল বাড্ডায় (গলির রাস্তার ওপর বাজার) ছোট একটি ভাতের হোটেল নেন। যেখানে হালিমসহ দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। মেলে বিকালের নাস্তাও। হোটেলটিও চলছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎ থেমে যায় গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর। স্ট্রোক করেন স্বামী মলয় শাহ্। আর চিকিৎসার জন্য শুরু হয় ময়নার এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়া আসা। ফুরিয়েছে জমানো সব টাকা। ধার-কর্জেও হাত পড়েছে। তাও যদি স্বামী ফেরেন স্বাভাবিক জীবনে। যদিও ডাক্তার বলেছেন- আর ফিরবেন না। শরীরে বাঁধিয়েছেন ভয়াবহ অসুখ।

ডাক্তারের কথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়া অবস্থা ময়নার। একদিকে মেয়ে রনজিতা শাহ্ রাত্রী (১৭) পড়ছেন উচ্চমাধ্যমিকে। মেয়ের বিবাহের কথাও চলছিল। ছেলে জয় দ্বাস (২০) তখনও বেকার। স্বামীর চিকিৎসা, সংসারের খরচ, প্রতিমাসে বাসা ভাড়া (ভাইয়ের বাসায় থাকলেও তাদের নামে মাত্র ৩ হাজার টাকা ভাড়া দেন) আর মাস শেষ না হতেই ৮ হাজার টাকা দোকান ভাড়া। যেন এক অথৈই সাগরে পড়েন এই গৃহিণী।

একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই কিছু করবেন। কী করবেন, তা ভাবারও যেন সময় নেই হাতে। স্থির সিদ্ধান্ত, আবারও খুলবেন দোকানের কপাট। নিজেই হয়ে উঠেন গৃহিণী থেকে দোকানি।

নারী দিবসের একদিন আগে গত ৭ মার্চ সকালে ময়না দিদির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ত সময় কাটছে তার। সঙ্গে মেয়ে রনজিতা শাহ্ রাত্রী তাকে সাহায্য করছেন। তিনি এসেছেন অসুস্থ বাবাকে দেখতে। ময়না দিদির যেন কথা বলার জো নেই। কাজের ফাঁকে কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে।


বিজ্ঞাপন


ময়না জানান, ‘প্রথমে মনে হয়েছিল, আমি পারব না। কারণ, আমি নারী। সব পরিস্থিতি একসময় জানান দেয়, আমাকেই পারতে হবে। না পেরে তো আর উপায় ছিল না।’

গত দুই মাস ধরে তিনি দোকান চালাচ্ছেন। অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, সবগুলো কাজই আমি পারি। তবে পরটা তৈরি করাটা একটু কঠিন মনে হয়েছিল, এখন পারি। এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। ময়না দিদি বলে ডাকেন। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। উপায় নেই, এ কথা আর বলব না, ভালোবেসেই এখন কাজ করি। কাস্টমার না আসলে মন খারাপ হয় মাঝেমধ্যে।

ময়না জানান, ‘উনি (স্বামী) স্ট্রোক করার পর কিছুদিন দোকান বন্ধ ছিল। স্বপ্নের দোকানটি নিয়েছিলাম গত বছরের শেষদিকে। কিছু দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। ছোট দোকানটি (হালিমের) ছেড়ে এ দোকানটি নেওয়া ছিল স্বপ্নের মতো।’

অদম্য এই নারী আরও জানান, স্বামীর বাড়ি-ভিটেমাটি নেই। ইতোমধ্যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ভাই অনিল দাস ও মলিন দাসের আশ্রয়ে নামেমাত্র তিন হাজার টাকা ভাড়ায় থাকছি দুই রুমের টিনের ঘরে। পাশাপাশি দিতে হয় বিদ্যুৎ বিল। কথা ছিল, মেয়েটার বিয়ে দিয়েই তাদের বাসা খালি করে দিব। এখন আবার স্বামীর অসুস্থতা। যেন বিপদ ছাড়ছে না।

ময়না দিদি জানান, সকাল থেকে তিনি নিজেই দোকান চালন। পরটা, সিঙ্গারাসহ দুপুরে বিক্রি করেন ভাত। সন্ধ্যার পর বিক্রি করেন নাস্তা। সে সময়টাতে (সন্ধ্যা) ছেলে জয় দাস সময় দেন। পাশাপাশি রয়েছে মো. ফারুক নামে একজন কর্মচারী।

আক্ষেপ করে ময়না বলেন, কিছু মানুষ আমার দোকানে এসে আবার চলে যায়। কেন চলে যান- এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, হিন্দু বলে। তবে কিছু কাস্টমার আমার দোকান ছাড়া কোথাও খায় না। কোনোদিন যদি সে সকল কাস্টমার না আসে, আমারও ভালো লাগে না। মিস করি।

আপনার কাছে জীবনের অর্থ কী- এমন প্রশ্নের উত্তরে ময়না দিদি বলেন, জীবনে দুঃখ থাকবেই। যুদ্ধ থাকবে। আমি যুদ্ধ করছি। সংসার নিয়ে। স্বামীকে নিয়ে। সন্তানদের নিয়ে। দোকান নিয়ে। এ যুদ্ধ মেনে নিয়েছি। এখন এই সংগ্রামই আমর ভালো লাগে।

যেদিন দোকানে বেচাবিক্রি বেশি হয়, সেদিন খুব ভালো লাগে। কম বিক্রি হলে সব খরচ দিয়ে আর নিজের মজুরির হিসাব পাইনা। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে না পারার কারণেই এমন হচ্ছে বলে তার ধারণা। টিসিবি পণ্যও ক্রয় করা অসম্ভব। সকালে গেলে পেতে পেতে দুপুর হয়ে যায়।

এদিকে, দোকানের কর্মচারী ফারুক জানান, দিনে ৫০০ টাকা করে হাজিরা পান তিনি। সঙ্গে খাবার ও নাস্তার জন্য পান ৩০ টাকা। ময়না দিদির দোকানে কাজ করে ভালোই চলে তার সংসার।

ডিএইচডি/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর