রাজধানীর বাসাবো এলাকায় পরিবারসহ বসবাস করেন রিনা আক্তার। তিনি পেশায় একজন গৃহিনী। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত আছেন। তাদের দুই মেয়ে সন্তান, একজন ক্লাস ফোরে পড়ে, আরেকজন হাঁটতে শিখছে। বড় মেয়েটা বাসায় যতক্ষণ থাকে প্রায় সারাদিন মোবাইল ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। কার্টুন দেখে, গেম খেলে। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই সময় কাটে তাদের। আর ছোট বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর সময় মোবাইলে ভিডিও না চালু করে দিলে খেতেই চায় না।
রিনা আক্তার বলেন, ‘বাচ্চাদেরকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। সারাদিন মোবাইল ছাড়া কিছুই বুঝে না তারা। এখনই যেভাবে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হচ্ছে বড় হয়ে যে কি হবে তা নিয়ে টেনশন হয়।’
বিজ্ঞাপন

একই এলাকা জাহিদ নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বাচ্চার (ছেলে) বয়স কেবল আড়াই বছর চলছে। তার বয়স এক বছর হওয়ার পর থেকেই মোবাইল ফোন ছাড়া কিছুই বোঝে না। তার হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার কান্না থামাতে মোবাইল হাতে দেওয়া লাগে। খাওয়ার সময় যতক্ষণ মোবাইলে কার্টুন চলে ততোক্ষণ খায়। মোবাইল নিয়ে রাখলে আর খেতে চায় না।’
এরকম দু-একজন নয়। শহর এলাকার প্রায় শতভাগ শিশুই স্মার্টফোনে আসক্ত। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। প্রায় সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই একই অবস্থা।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিভাইস আসক্তির মাধ্যমে কোমলমতি শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। ডিভাইস আসক্তি একদিকে শিশুদের যেমন মেধা ধ্বংস করছে, তেমনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে কর্মস্পৃহা।
ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ২৫ শতাংশের বয়সই ১০ বছরের কম। ফেসবুকসহ সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়ার ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়সই ১৮ থেকে ২৯-এর মধ্যে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডিভাইস আসক্তি শিশুদের অনেক বড় সমস্যা। একটা শিশুর জন্মের পর থেকেই ব্রেইন ডেভলপমেন্ট শুরু হয়। আমরা তাকে যা শেখাই সে সেটাই গ্রহণ করে। বাচ্চা ছোট থাকতেই যখন তার হাতে আমরা ডিভাইস তুলে দেই। প্রথমে হয়তো কান্না থামাতে অল্প একটু দিলাম, এভাবে ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে খাওয়ানোর সময় যে ডিভাইস আসক্তি এটা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর। মানুষ যখন কোনো খাবার খায় সেটা খাওয়া আগে তার মুখে এক ধরনের তরল নিঃসৃত হয়। যা হজমে সাহায্য করে। বাচ্চারা যখন মোবাইলে ভিডিও দেখতে দেখতে খায় তখন তাদের মনোযোগ থাকে মোবাইলের দিকে। তাই খাওয়ার সময় মুখের সেই তরল নিঃসৃত হয় না। এতে হজমের সমস্যা হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর।
গ্রামের থেকে শহরের শিশুরা ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে বেশি। যার অন্যতম প্রধান কারণ বিনোদনের উপযুক্ত স্পেস না থাকা। খেলার মাঠ না থাকায় তারা খেলতে পারছে না। তাই মোবাইলটাকেই তারা খেলার মাঠ হিসেবে বেছে নিয়েছে।

এ বিষয়ে ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনিরা হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শিশুদের ডিভাইস আসক্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের জন্য বিনোদন স্পেস তথা খেলার মাঠ নাই। বিশেষ করে ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে এই সমস্যা বেশি। তাই তারা ডিভাইসকেই বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর এখন শহরের যারা বাবা-মা আছেন অধিকাংশ পরিবারেই দুইজনেই ব্যস্ত থাকে। তাই তারা বাচ্চাদেরকে ওভাবে সময় দিতে পারছে না। এজন্য বাচ্চারা সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন ডিভাইস বা স্মার্টফোন।
ডিভাইস আসক্তি থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে শারীরিক মানসিক অনেক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে শিশুদের। একটা সময় পুরো প্রজন্ম রোগা হয়ে বেড়ে উঠবে। তাই যে কোনো মূল্যে ডিভাইস আসক্তি দূর করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
টিএই/এএস

