গতবছর প্রথম দশ মাসে শিশু নিহতের সংখ্যা ছিল ৪২১ জন। কিন্তু সেটি চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে দাঁড়িয়েছে ৪৮২ জনে, যা গতবছরের তুলনায় ৮১ জন বেশি। তবে এবার জুলাই ও আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় বেড়েছে। গতবার প্রথম দশ মাসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ৯২০। তা এবার ৫৮০ জনে দাঁড়িয়েছে। সেই তুলনায় কমেছে।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাংবাদিক মানিক মিয়া অডিটোরিয়ামে শিশু অধিকার রক্ষায় অগ্রগতি: প্রত্যাশা ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য ওঠে আসে।
বিজ্ঞাপন
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর আয়োজনে এই সভায় আসকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা এসব তথ্য ও উপাত্ত দেশের বহুল প্রচলিত ১০টি দৈনিক পত্রিকা ও গ্রহণযোগ্য অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং কিছুক্ষেত্রে নিজস্ব সূত্রমতে তৈরি করেছেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ।
সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আইকের প্রজেক্ট অফিসার শান্তা ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছরগুলোর মতোই ২০২৪ সাল জুড়েও, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ শিশুর প্রতি নানা সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থেকেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাবমতে, এ সময়কালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, সহিংসতার কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৪৮২ জন শিশু।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয় ২১৭ জন শিশু, ১৫ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ৬১ ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ৩৪ জন শিশু। যার মধ্যে শিক্ষিতের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৩২ ছেলে শিশু। এছাড়াও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর রাজশাহী শহরের ১০ বছরের কম বয়সী ৩০ জন স্কুলছাত্রকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা আলোচনায় আসে। ২০০৯ সালের যৌন হয়রানি বন্ধের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এইসব প্রতিরোধে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক আইন প্রণয়ন করা জরুরি।
বিজ্ঞাপন
এসময় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান ও পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে কোয়ালিশন নানা সুপারিশ সরকারের কাছে তুলে ধরেন। তাদের সুপারিশগুলো হলো—
১. আইনগুলো সংশোধন করা। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত ও নিহত শিশুদের পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য তালিকা প্রকাশ করা। নিহতের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও আহত শিশুদের জন্য সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা করা।
২. শিশুদের জন্য পৃথক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা এবং দ্রুততার সাথে পৃথক শিশু অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা।
৩. শিশুদের সাথে প্রাক-বাজেট এবং বাজেট-পরবর্তী পরামর্শ সভার আয়োজন করা। আগামী অর্থবছর থেকে, পর্যায়ক্রমে শিশু-কেন্দ্রিক বাজেট ও প্রতিবেদন তৈরি এবং প্রকাশ করা।
৪. শিশু আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী পরীবিক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে, শিশু সহায়তা ডেস্ক গঠন করা, প্রতিটি থানায় শিশুদের সহায়তার জন্য পৃথক পুলিশ অফিসার নিয়োগ করা।
৫. সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্টভাবে বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, আবাসিক প্রতিষ্ঠানসহ যে কোন কাঠামোতে শিশুদের উপর শারীরিক এবং অপমানজনক শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করে শিশু আইন ২০১৩-এ একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।
৬. শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা।
৭. ধর্ষণের সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ করা, এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনের যথাযথ সংশোধনের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া।
৮. অনলাইনে শিশু যৌন শোষণ রোধ করতে বিদ্যমান আইনগুলিতে; যেমন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২, শিশু আইন ২০১৩ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এ; সাইবার অপরাধের নতুন রূপগুলিকে সংজ্ঞায়িত এবং অন্তর্ভুক্ত করা।
৯. শিশু পাচার সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিচার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সাতটি মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানো।
১০. শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, আঘাত বা ব্যাধি কাটিয়ে উঠতে মনোসামাজিক সহায়তা (যেমন, কার্যকর কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি) নিশ্চিত করা।
১১. বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বাল্যবিয়েকে শুরুতেই বাতিল (Void ab Initio) ঘোষণা করে।
১২. একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা, কেননা আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এই বিয়েগুলি অবৈধ হয় না।
১৩. বাল্যবিয়ে নিরোধে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটিগুলোর কার্যক্রম জোরদার করা।
১৪. বাল্যবিয়ে নিরোধে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি কে ডিজিটালাইজেশন করা।
১৫. মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি অভিন্ন এবং বৈষম্যহীন পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করা; জবাবদিহিতা এবং সকল শিশুর জন্য
১৬. মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
১৭. গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আইন প্রণয়ন করা, এবং আইএলও কনভেনশন ১৮৯ অনুস্বাক্ষর করা। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের ঐচ্ছিক প্রোটোকল ৩ (যোগাযোগ প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের তৃতীয় প্রটোকল) অনুস্বাক্ষর করা এবং অনুসমর্থন করা।
১৮. চতুর্থ পর্বের ইউপিআরে প্রাপ্ত শিশু অধিকার বিষয়ক সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য অংশীজনদের সাথে আলোচনাসাপক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
১৯. জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটি প্রদত্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পযার্লোচনা করে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের আওতায় পিরিওডিক প্রতিবেদন প্রদান।
এসময় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, টেরে হোমস নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এম কবির, আসকের কোঅরডিনেটর তামান্না হক রিতি, ইডুকো বাংলাদেশের পলিসি ও অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার হালিমা আকতার, সস চিলড্রেনস ভিলেজ বাংলাদেশ এর ডিপুটি ডিরেক্টর-এডভোকেসি নুসরাত জাহান শাওন উপস্থিত ছিলেন।
এমআইকে/এমএইচটি