বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হার না মানা ‘একলা মায়ের’ কাহিনি

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ০৯ মে ২০২২, ০৩:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

হার না মানা ‘একলা মায়ের’ কাহিনি

জীবনের গল্প অনেকসময় বাস্তবকেও হার মানায়। মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করার স্বপ্ন দেখেন সব নারীই। তবে সেই স্বপ্ন সবার জীবনে স্থির হয় না। কখনো ভেঙে যায় সাজানো ঘর। বাস্তবতার কাছে মুখ থুবড়ে দাঁড়ায় সব অনুভূতি। ঢাকা মেইলের মুখোমুখি হয়েছেন এমন একজন মা। নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে যিনি লড়ে যাচ্ছেন একাই। সমাজের সব বাধা ভেঙে টিকে রয়েছেন সন্তানকে নিয়ে। সিঙ্গেল মাদার এই নারীর গল্প জানুন এই প্রতিবেদনে।   

স্বামী আর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল জুবায়দা মিতির। সে সংসারে হঠাৎ ফাটল ধরায় পরকীয়া। অন্য নারীতে আসক্ত হন স্বামী। মিতিকে না জানিয়েই দিয়ে দেন ডিভোর্স।


বিজ্ঞাপন


মিতি বলেন, ‘আমার স্বামী এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। ফলে সে আমাকে না জানিয়েই ডিভোর্স দেয়। আমার স্বামী তার যার সাথে সম্পর্ক সেই নারীকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যায়। এসবের পরও আমি শ্বশুর-শাশুড়ির সম্মানের কথা ভেবে তাদের সঙ্গে থাকি। প্রায় আড়াই বছর থাকার পর বুঝি, তারা আসলে তাদের সন্তানকে বাঁচানোর স্বার্থেই আমাকে রেখেছেন।’

mitiএকদিন হঠাৎ মেয়ের পাসপোর্ট খুঁজে পাচ্ছিলেন না মিতি। বুঝলেন, তার থেকে মেয়েকে আলাদা করতে গোপন পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, এই বাড়িতে থাকা যাবে না। কন্যা জারাকে নিয়ে চলে আসেন মায়ের বাড়ি।

মিতি বলেন, ‘বেড়ানোর কথা বলে মায়ের বাসায় যাই এবং মাকে অনেক কষ্টে বোঝাই যে আমি আর ফিরব না। আমার বাবা নেই। মা ক্যানসারের আক্রান্ত ছিলেন। তার জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না। আমার শ্বশুর কথা দিয়েছিলেন যে আমার আর আমার মেয়ের সারাজীবনের দায়িত্ব নেবেন। মা সেই ভরসায় ছিলেন। কিন্তু, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বাসা ছেড়ে আসার আগে আড়াই মাস আমি একবেলা ঠিকমতো ভাত খেতে পারিনি। তারা খেতে দেননি। তবে শিক্ষিত হওয়ায় তাদের অত্যাচার ছিল ভিন্ন। গায়ে হাত তুলত না ঠিকই। কিন্তু আমার জন্য তারা রান্না করতেন না। আমি রান্না করলে খেতেন না।’ 

সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাসায় আসার পর শুরু হয় মিতির আসল যুদ্ধ। শ্বশুরবাড়িতে মানসিক কষ্ট হলেও বিভিন্ন প্রয়োজনে অর্থ, মেয়ের স্কুলের ফি এসব নিয়ে অন্তত ভাবতে হত না। মায়ের বাসায় আসার পর মানসিক কষ্টের সঙ্গে যোগ হয় আর্থিক কষ্ট। নিজের বড় ভাই মেনে নিতে পারেননি বোনের ফিরে আসা। মাকে নানা কথা বলে বোঝাতেন। মিতিকে খোটা দেওয়া, অপমান করা-সবই করতেন। 


বিজ্ঞাপন


mitiসন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হওয়া প্রসঙ্গে মিতি বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছিল অবস্থা সম্পন্ন। সেখানে অন্যরকম জীবনযাপন করতাম আমি আর আমার মেয়ে। এসি রুমে থাকা, নিজের গাড়িতে চড়া। মেয়েকে নিয়ে সেখান থেকে বের হওয়ার সময় এসব কিছুই আমার মাথায় ছিল না। আমি শুধু ভেবেছি যেভাবেই হোক, আমার সন্তানকে আমার কাছে রাখতে হবে। একজন রিকশাওয়ালা যদি রিকশা চালিয়েও তার সন্তানকে লালন-পালন করতে পারে, আমিও কিছু একটা করতে পারব।’

মায়ের মন তো এমনই হয়। নিজের নাড়ী ছেড়া ধনকে কে না আগলে রাখতে চায়? কিন্তু জীবন তো এত সোজা নয়। বাঁচতে গেলে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতেও অর্থও লাগে। তাই চাকরি খুঁজতে থাকেন মিতি। একটি চাকরি পেয়েও যান। বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা। চাকরি পেলেও শান্তি পাচ্ছিলেন না মিতি। নিজের ঘরেই যেন পর হয়ে ছিলেন। 

তিনি বলেন, ‘মাকে বলেছিলাম, এক বছর আমাকে একটু থাকার জায়গা দিতে। এরপর আমি সব সামলে নেব। তবুও কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। ভাইয়ের খোটা, আমার মেয়ের প্রতি মায়ের অবহেলা থাকতো। মা ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। আমি আর মেয়েও সেখানে থাকতাম। একদিন ঝগড়ার জেরে মা বাড়ি ছেড়ে আলাদা ফ্ল্যাটে চলে গেলেন। আমি চিন্তায় পড়লাম। আমার মেয়েকে দেখভাল, চাকরি-কীভাবে সামলাব?

mitiতবুও হার মানেননি মিতি। ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে চালিয়ে যান যুদ্ধ। এসি গাড়িতে চড়া মেয়েকে লেগুনায় করে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন। এমনই দিন গেছে যে মেয়েকে একটা ডিম ভেজে অর্ধেক সকালের নাস্তায়, অর্ধেক টিফিনে দিয়েছেন। এর মধ্যেই ছোট ভাই সংসারে খরচ দিতে চাপ দেন। বিভিন্ন কাজ করে ২-৩ মাস ৫ হাজার করে টাকা দেন মিতি। এরপর আর সম্ভব হচ্ছিল না। ফের ভাইয়ের খোঁটা শুরু হয়।  

এরপর ১৭ হাজার টাকায় নতুন চাকরি পান মিতি। বনশ্রীতে থাকলেও মেয়ের স্কুল ছিল পল্টনে, তার অফিসও।

মিতি বলেন, ‘ভাইকে বলি মাসে ১০ হাজার টাকা দিব। যেন আমার মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করে। সে বারবার অসম্মতি জানায়। সপ্তাহখানেক আনা-নেওয়া করে জানায় সে আর পারবে না। আমি মেয়েকে স্কুল থেকে এনে অফিসের ডেস্কের নিচে রাখতাম। ওর স্কুলের ফ্রেন্ডদের মায়েদের অনুরোধ করতাম যে আমার বাচ্চাটাকে একটু বাসায় নিয়ে রাখে।’

mitiমেয়ের স্কুলের বান্ধবী, নিজের বান্ধবীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মিতি। কঠিন সে সময়ে যখন একটু সাহায্যের জন্য সবার দুয়ারে ঘুরছিলেন তখন তারাই তাকে সাহায্য করে। এর মধ্যে ছোটভাইয়ের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব হয়। ভাই বাসা ছেড়ে দিতে বলে। এরপর মেয়েকে নিয়ে এক বান্ধবীর বাসায় ২ মাস থাকেন মিতি। তারপর সাবলেটে এক রুম ভাড়া নেন। 

অফিসে বেতন কিছুটা বাড়ার পর আলাদা বাসা নেন মিতি। সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বাসায় এসে রান্নাবান্না করেন। এরপর অফিসে যান। লাঞ্চ ব্রেকে মেয়েকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যান। তালাবন্ধ করে রেখে আবার ফেরেন অফিসে। এখনও এভাবেই চলছে মিতির জীবনযুদ্ধ। 

ক্লাস ওয়ানে পড়ুয়া মেয়ে জারা এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছে সেও। একইসঙ্গে আরও শক্তিশালী হয়েছে একজন একা মায়ের মানসিকতা। এক্ষেত্রে অফিসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মিতি। অফিসই তাকে সাহায্য করে কাজের ফাঁকে মেয়েকে বাসায় দিয়ে আসা কিংবা জরুরি প্রয়োজনে অফিস থেকে বের হতে। 

mitiসমাজের সব মা-বাবার উদ্দেশ্যে মিতি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের মেয়েদের পড়াশোনা শেষ করিয়ে চাকরি করতে দিন। এরপর বিয়ে দিন। অন্তত স্বামীর সংসারে কোনো সমস্যা হলে যেন নিজে কিছু করতে পারে। আর কোনো মেয়ে যদি স্বামীর সংসার থেকে প্রতারিত হয়ে আপনাদের কাছে ফিরে আসে, তাহলে তাকে একটু ভালোবেসে আগলে রাখবেন। এই সময়ে পারিবারিক সহযোগিতা একটা মেয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ 

আমাদের সমাজে সিঙ্গেল মাদার বিষয়টিতে এখনও ট্যাবু রয়ে গেছে। স্বামীর সংসার করতে পারলো না মানে এটি তার ব্যর্থতা। এমন ধারণা থাকে অনেকের। কিন্তু বাস্তবে পর্দার পেছনের গল্প হয়তো অন্যরকম হয়ে থাকে। স্বামী থেকে প্রতারিত হয়েও একজন নারী যখন সন্তানকে বুকে আগলে নিজের মতো বাঁচতে চান তখন তাকে সমর্থন করা উচিত সবার। সেটুকু সম্ভব না হলেও, অন্তত তার চরিত্র নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা উচিত। 

এনএম/এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর