রোববার, ১৬ জুন, ২০২৪, ঢাকা

পথে শুরু পথেই শেষ, শেষযাত্রাও ‘বেওয়ারিশ’

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১০:২২ পিএম

শেয়ার করুন:

পথে শুরু পথেই শেষ, শেষযাত্রাও ‘বেওয়ারিশ’
  • অনিশ্চিত জীবন ও ভবিষ্যৎ
  • যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার
  • নিদারুণ কষ্টে অন্ধ-প্রতিবন্ধী পথশিশুরা
  • অসুস্থ হলে ‘বড়ি’ই ভরসা
  • বাজেটে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রয়োজন
  • শিশু অধিদফতর গঠনের দাবি বিশেষজ্ঞদের
  • শিশু নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে

রাজধানীর মহাখালীর সড়ক ভবনের পাশে আমতলী এলাকায় রেললাইনের ধারে পড়ে ছিল তিন শিশুর নিথর দেহ। তিনজনই ট্রেনের চাকার নিচে কাটা পড়েছিল। ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ভোর আনুমানিক ৬টার দিকে। সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই নিভে যায় তাদের জীবনপ্রদীপ। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। অবশেষে পুলিশ সদস্যরা এসে লাশ তিনটি উদ্ধার করেন। নিহত সবার বয়স ছিল ১০-১৩ বছরের মধ্যে।


বিজ্ঞাপন


এরপর নিহত তিন শিশুর পরিচয় শনাক্তে মহাখালী ও আশপাশে ব্যাপক তৎপরতা চালান বিমানবন্দর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুনীল চন্দ্র সূত্রধর। সোর্সের মাধ্যমেও চেষ্টা করা হয়। তাদের ছবি নিয়ে মহাখালীর আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়। বিভিন্ন থানায় ছবি পাঠানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও চেষ্টা করেছিলেন।

পরিচয় শনাক্তের চেষ্টার ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। সব উদ্যোগের পরও তিন শিশুর একজনেরও পরিচয় মেলেনি। স্থানীয়রা শুধু এতটুকুই জানাতে পেরেছিলেন, তাদেরকে এলাকাতেই সব সময় ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। অবশেষে দুর্ঘটনার ১৯ দিন পর গত ১২ অক্টোবর ‘বেওরারিশ’ হিসেবে ওই তিন পথশিশুর লাশ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।

যাদের নাম-পরিচয়, ঠিকানা বা জন্মসূত্র জানা যায় না সমাজে তাদেরকে বলা হয় ‘বেওয়ারিশ’। এমন ‘বেওয়ারিশ’ বা নাম-পরিচয়হীনভাবে দাফন হওয়া পথশিশুদের সংখ্যা হাজার হাজার। চার দেয়ালের মধ্যে জন্ম হলেও শৈশব কাটে তাদের পথে পথে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও স্বজনদের আদর সোহাগ না পাওয়া এসব শিশুর একমাত্র সঙ্গী আরেক পথশিশু। এজন্য ছোটো ছোটো দলে তারা চলাফেরা করে। রাতের আকাশই তাদের জন্য ছাদ। শৈশব কাটে তাদের পথে পথে। এসব শিশুর খাবারের প্রধান উৎস ভিক্ষাবৃত্তি।

সুনীল চন্দ্র সূত্রধর ঢাকা মেইলকে বলেন, ওই তিন শিশুর পরিচয় জানতে না পারায় আমরা সরকারের নিয়ম অনুযায়ী বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করি। তারা রায়ের বাজার কবরস্থানে লাশগুলো দাফন করে।


বিজ্ঞাপন


নাম-পরিচয়হীন এ তিন শিশুকে দাফনের দিনই রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় বাসের ধাক্কায় আহত হয় ৭-৮ বছরের পথশিশু প্রিয়া। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ এক হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হলে মাঝরাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন শুক্রবার দুপুরের দিকে তার মৃত্যু হয়। নাম জানা গেলেও পরিচয় পাওয়া যায়নি ওই শিশুরও।

deadbody

ছবি: সংগৃহীত

যাদের নাম-পরিচয়, ঠিকানা বা জন্মসূত্র জানা যায় না সমাজে তাদেরকে বলা হয় ‘বেওয়ারিশ’। এমন ‘বেওয়ারিশ’ বা নাম-পরিচয়হীনভাবে দাফন হওয়া পথশিশুদের সংখ্যা হাজার হাজার। চার দেয়ালের মধ্যে জন্ম হলেও শৈশব কাটে তাদের পথে পথে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও স্বজনদের আদর সোহাগ না পাওয়া এসব শিশুর একমাত্র সঙ্গী আরেক পথশিশু। এজন্য ছোটো ছোটো দলে তারা চলাফেরা করে। রাতের আকাশই তাদের জন্য ছাদ। শৈশব কাটে তাদের পথে পথে। এসব শিশুর খাবারের প্রধান উৎস ভিক্ষাবৃত্তি। জন্মের পর তাদের দায় যেমন কেউ নেয় না, তেমনি বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার মতো মৌলিক অধিকারও দিচ্ছে না রাষ্ট্র। জন্মসনদ যেমন নেই, তেমনি এ দেশের নাগরিক হয়েও ‘পরিচয়হীন’ভাবেই অকালে ঝর যাচ্ছে এসব শিশু। ফলে পথশিশুদের জীবন রাষ্ট্রের ‘অগোচরেই’ থেকে যাচ্ছে।

২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৯৪টি মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু ও নবজাতক। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লাশের অনেকগুলো বিকৃত অবস্থায় থাকে। এজন্য সংস্থাটি বেওয়ারিশ সব লাশের ছবি সংরক্ষণ করার পাশাপাশি সহজে দৃশ্যমান করতে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। আনজুমান মুফিদুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের অফিসের নিচতলার একটি কক্ষে টানানো বেওয়ারিশ লাশের ছবির বড় অংশই নারী ও শিশুর।

গত মে মাসে রাজধানীর মহাখালীতে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে লোহার রড পড়ে মারা যায় আনুমানিক ১২ বছরের এক পথশিশু। একই মাসে বরিশালের কীর্তনখোলা নদী থেকে নিখোঁজের দুই দিন পর এক পথশিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তারও শেষ যাত্রা হয় বেওয়ারিশ হিসেবে।

বছরে কতজন পথশিশু এভাবে নাম-পরিচয়হীন অবস্থায় মারা যায় ও দাফন করা হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ফাউন্ডেশন প্রতিবছর যত লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে তার বড় অংশই ১৮ বছরের নিচে। বেসরকারি এই দাতব্য সংস্থাটির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৯৪টি মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু ও নবজাতক। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লাশের অনেকগুলো বিকৃত অবস্থায় থাকে। এজন্য সংস্থাটি বেওয়ারিশ সব লাশের ছবি সংরক্ষণ করার পাশাপাশি সহজে দৃশ্যমান করতে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। আনজুমান মুফিদুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের অফিসের নিচতলার একটি কক্ষে টানানো বেওয়ারিশ লাশের ছবির বড় অংশই নারী ও শিশুর।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা বেশ জটিল কাজ। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম যেখানে-সেখানে লাশ পেলেই যে দাফন করবে সেটা না। দাফন প্রক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জড়িত। নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর আমরা দাফন সম্পন্ন করি।

anjuman
২০১০ সাল থেকে নিয়ে চলতি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৯৪ জনের লাশ বে-ওয়ারিশ হিসেবে করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। এর মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু ও নবজাতকের লাশ। ছবি: ঢাকা মেইল

দেশের পথশিশুদের শোচনীয় জীবন যাপনের চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শীর্ষক এক জরিপে। ইউনিসেফের সহায়তায় করা এই জরিপে ঢাকা ও দেশের আটটি বিভাগের হটস্পটে ৫-১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৮২ শতাংশ ছেলে এবং তাদের বেশিরভাগ দারিদ্র্যের কারণে বা কাজের সন্ধানে রাস্তায় আসে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ শিশু এতিম অথবা তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা তা তাদের জানা নেই। এমনকি এই শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে প্রায় একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন একটি ঘর থেকে বঞ্চিত। তারা পাবলিক বা খোলা জায়গায় থাকে ও ঘুমায়। জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ, ভিক্ষাবৃত্তি বা চায়ের দোকান, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করতে বাধ্য হওয়া এই শিশুরা প্রতিদিন আঘাত ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। পথশিশুদের প্রতি দশজনের মধ্যে আটজনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হয়। রাস্তায় থাকা শিশুদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন (৭১ দশমিক ৮ শতাংশ) পড়তে বা লিখতে পারে না, যা জীবনভর তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়ে যায় এবং তাদেরকে নির্মম ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়।

রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় কয়েকজন পথশিশুর সাথে কথা হয় ঢাকা মেইলের। আনুমানিক ১০ বছরের শিশু মাসুদ বলেন, জ্বর-বেদনা হইলে ওই দোকান (ফার্মেসি) থেইকা বড়ি (ওষুধ) কিইনা খাই। ২-৪ দিন শুইয়া থাকলে রোগ ভালো হইয়া যায়।

জরিপে রাস্তা-ঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যা না থাকলেও ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে। জরিপে ওই বছর কত সংখ্যক পথশিশু মারা গেছে বা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে তার তথ্য উঠে আসেনি।

streetccc
কমলাপুর রেলস্টেশনে ধুলা-বালির অস্বাস্থকর পারিবেশে শুয়ে আছে পথশিশুরা। ছবি: ঢাকা মেইল

জরিপ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ‘বিবিএস’র উপ-পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা পথশিশুদের নিয়ে যে সার্ভে করেছিলাম তাতে শিশুদের স্বাস্থ্যসহ আরও অনেক বিষয়ের পরিসংখ্যান আছে। কত সংখ্যক শিশু মারা যায় সে তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। কারণ বিষয়টি বেশ জটিল প্রক্রিয়া। অন্য কোনো দফতরে আছে কি না আমার জানা নাই। সামনে তো আবারও পরিসংখ্যান হবে, সেটাতে দেখা যাক এটা নিয়ে কাজ করা যায় কি না।

অসুস্থ হলে ‘বড়ি’ই ভরসা

অসুস্থ হলে পথশিশুদের সেবা করার কেউ নেই। হাসপাতালে ভর্তি হলে খোঁজ নেওয়ারও থাকে না কেউ। অসুস্থ হলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়াই একমাত্র চিকিৎসা। এতে দীর্ঘমেয়াদী রোগের ঝুঁকি থেকে যায়।

ইউনিসেফের জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের অর্ধেকের বেশি জানায়, জরিপের আগের তিন মাসের মধ্যে তারা জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। রাস্তায় থাকা শিশুদের সেবা প্রদান করে এমন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা যে সহায়তা পেতে পারে সে সম্পর্কে বেশিরভাগ শিশুই (৭৯ শতাংশ) জানে না। রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় কয়েকজন পথশিশুর সাথে কথা হয় ঢাকা মেইলের। আনুমানিক ১০ বছরের শিশু মাসুদ বলছিল, ‘জ্বর-বেদনা হইলে ওই দোকান (ফার্মেসি) থেইকা বড়ি (ওষুধ) কিইনা খাই। ২-৪ দিন শুইয়া থাকলে রোগ ভালো হইয়া যায়।’

sick
অসুস্থ হলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খেয়েই চিকিৎসা শেষ হয় পথশিশুদের। ছবি: ঢাকা মেইল

ডেঙ্গু-করোনার ‘পরোয়া’ করে না তারা

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে এ পথশিশুরা। বেশিরভাগ শিশুই ঘুমায় ডেঙ্গুর হটস্পটে। রাস্তায় ঘুমানো প্রায় সব শিশুই ঘুমায় মশারি ছাড়া, মশার সাথেই তাদের বসবাস। অনেকেই ঘুমের আগ মুহূর্তে কাগজ পুড়িয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করে।

কমলাপুরে রেলস্টেশনে বসবাসকারী পথশিশু রিপন বলেন, ‘আমাগোরে মশায় ধরে না। হ্যাতির (তাদের) সাথে আমাগোর ভাব হইয়া গেছে। রাইতে ঘুমানোর আগে একটু কাগজ জ্বালাইয়া দেই। ঘুমাইলে আর কিছু টের পাই না।’

এমনকি ২০২০-২০২১ সালের কোভিডের ভয়াবহ অবস্থার সময়ও এমন নির্বিকার জীবনই পার করেছে তারা।

নিদারুণ কষ্টে অন্ধ-প্রতিবন্ধী পথশিশুরা

পথশিশুদের বড় একটা অংশ অন্ধ বা প্রতিবন্ধী। অনেককেই চলাফেরা করতে হয় অন্যের সহযোগিতায়। বিভিন্ন স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, টার্মিনাল এলাকায় এসব অনেক পথশিশুকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। এমনিতেই পথশিশুরা অবহেলিত, তার ওপর প্রতিবন্ধী পথশিশুদের কষ্ট আরও নিদারুণ।

দেশের পথশিশুদের ৫৮ শতাংশ মাদকে আসক্ত। গবেষণার অংশ হিসেবে ডিএনসি দেশব্যাপী ১ হাজার ৬০০ পথশিশুর সাক্ষাৎকার নেয়। এর মধ্যে ৯২৮টি শিশু বলেছে, তারা মাদক সেবন করে। অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকসেবি। এই ৯২৮ জনের মধ্যে ৩৩৬টি শিশু বলেছে, তারা মাদক সেবনের পাশাপাশি মাদকের বাহক হিসেবেও কাজ করে।

রাজধানীর কমলাপুর ফুটওভার ব্রিজের ওপর ভিক্ষা করছিল অন্ধ শিশু আয়াত। সাথে আরেক শিশু। আয়াত বলছিল, ‘এই এলাকায় একলা ঘুরতে ফিরতে পারি। অভ্যাস হইয়া গেছে। কিন্তু এর বাইরে যাইতে পারি না। তাও চলতে ব্যথা পাই। গেইট পর্যন্ত যাইতে পারি। এর বাইরে গেলে আরেকজনরে সাথে নিতে হয়।’

রাজারবাগ এলাকার ফুটপাতে স্ট্রেচারে ভর দিয়ে ভিক্ষা করা আনুমানিক ১৪ বছরের শিশু মনির। সে বলে, ‘আমাগোর দুঃখ কিডা বুঝব স্যার? উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সবখানেই ঝামেলা। সবাই যেমনে চলাফেরা করে আমরা তেমন পারি না। মানুষের কাছে চাইয়া খাইতে হয়। কেউ খবর লয় না।’

মাদকে ‘পথহারা’ পথশিশুরা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পথশিশুদের ৫৮ শতাংশ মাদকে আসক্ত। গবেষণার অংশ হিসেবে ডিএনসি দেশব্যাপী ১ হাজার ৬০০ পথশিশুর সাক্ষাৎকার নেয়। এর মধ্যে ৯২৮টি শিশু বলেছে, তারা মাদক সেবন করে। অর্থাৎ ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকসেবি। এই ৯২৮ জনের মধ্যে ৩৩৬টি শিশু বলেছে, তারা মাদক সেবনের পাশাপাশি মাদকের বাহক হিসেবেও কাজ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশুদের মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছেন মাদক কারবারিরা। পথশিশুরা খুব সহজে মাদক সংগ্রহ করতে পারে। ৫৩ শতাংশ শিশু সরাসরি কারবারিদের কাছ থেকে মাদক কেনে। ১৪ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা ১০ বছর বয়স হওয়ার আগে থেকেই মাদক নিচ্ছে। পথশিশুদের মধ্যে গাঁজা সেবনের প্রবণতা বেশি। তবে ঢাকার পথশিশুরা ড্যান্ডি বেশি সেবন করে। ৫-১০ বছর বয়সী পথশিশুদের মধ্যে ড্যান্ডি গ্রহণের প্রবণতা বেশি বলে গবেষণায় উঠে আসে।

যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার

ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলছে, রাস্তায় বসবাসকারী শিশুদের প্রতি দশজনের মধ্যে আটজনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এর বড় একটা অংশ যৌন হয়রানির শিকার।

‘গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি’ নামে এক বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ৭৯ শতাংশ পথশিশু জীবনের কোনো পর্যায়ে মানসিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। পিতৃপরিচয় না থাকা ৭৬ শতাংশ পথশিশুকে মানসিক নিপীড়ন, হেনস্তা, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শোনাসহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তির শিকার হতে হয়। তাছাড়া শুধু শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২ শতাংশ পথশিশু।

ঢাকা আহছানিয়া মিশন ও স্ট্রিট চিল্ড্রেন এক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক, স্ক্যান বাংলাদেশের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫১ ভাগ পথশিশু অন্যদের কাছ থেকে গালিগালাজ শুনে থাকে। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার ২০ ভাগ শিশু। যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে ৪৬ ভাগ কন্যা পথশিশু।

অনিশ্চিত জীবন ও ভবিষ্যৎ

পথশিশুদের জীবনের নেই কোনো নিশ্চয়তা। নেই কোনো ভবিষ্যৎ বা ভবিষ্যতের চিন্তা। সকালে কি খাবে তার কোনো ঠিক নাই। অধিকাংশ পথশিশুকেই চেয়ে থাকতে হয় অন্যের দিকে।

সারাদিন কি কি করে— এমন প্রশ্নের উত্তরে কমলাপুর রেলস্টেশনে বসবাসকারী আনুমানিক ১০ বছরের শিশু সাকিব ঢাকা মেইলকে বলল, ‘কমলাপুরে ট্রেন স্টেশনেই থাহি, ঘুমাই। সকালে কোনোদিন ভোরেই ঘুম থেইকা উঠি। উইঠা একটা বস্তা নিয়া প্লাটফর্মে যে ট্রেন আসে সেগুলাতে যাই, যাত্রীগো হালাইয়া (ফেলে) যাওয়া বোতল টোকাই। সেগুলা বেইচা ৪০-৫০ টেকা হয়। হেইডা দিয়া সকালে খাই। আবার যেদিন বোতল না টোকাই হেদিন ব্যাগ টানি। আমাগোরে সবাই ব্যাগ টানতে দেয় না। ব্যাগ টাইনা দিলে ৫০-৬০ টেকা হয়। সেইটা দিয়া এক বেলার খাওন হয়। আবার অনেকের কাছে চাইয়া খাবার খাই। এরপর এইহানেই ঘুইরা বেড়াই।’

শিশু সাকিব আরও জানায়, মাঝে মাঝে রাতে অনেকে খাবার দিয়ে যায়। প্লাটফর্মের পাশের পাবলিক টয়লেটে প্রাকৃতিক কাজ ও গোসল করে।

streetch
সকাল বা রাতে কখন কী খাবে তার কোনো ঠিক নেই। পথশিশুদের চেয়ে থাকতে হয় অন্যের দিকে। কমলাপুরের পথশিশুদের চিত্র এটি। ছবি: ঢাকা মেইল

কি করছে সরকারি সংস্থাগুলো

পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ১৯৮৯ সালে ‘পথকলি ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ‘শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট’ রাখা হয়। ট্রাস্টের প্রথম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাগ্যাহত, সুবিধাবঞ্চিত, হতদরিদ্র এবং নিজ প্রচেষ্টায় ও শ্রমে ভাগ্যোন্নয়নে প্রয়াসী শিশু-কিশোরদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ট্রাস্টটির অধীনে বাংলাদেশে ২০৫টি শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৯টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এতে ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে কোনো কাজ হয় না বলে জানায় সংস্থাটি।

এ বিষয়ে শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালক আবুল বাসার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের অধীনে যেসব শিশু আছে তারা পথে থাকে না। যেসব শিশু বাড়িতে থাকে বাবা-মায়ের সাথে কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে যেতে পারে না তাদেরকে একটা ফ্লেক্সিবল টাইমে আমরা প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকি। পথশিশুদেরকে নিয়ে আমরা কাজ করতে পারি না। তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে গেলে যে জিনিসগুলো দরকার হয় যেমন- খাদ্য, থাকার ব্যবস্থা, আমাদের সে ফ্যাসিলিটি নাই। অর্থাৎ পথশিশুরা আমাদের আওতায় পড়ে না। এটা নিয়ে সমাজসেবা অধিদফতর কাজ করে থাকে।

যদিও সমাজসেবা অধিদফতর বলছে, নির্দিষ্টভাবে শুধু পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে না তারা। তবে ভবঘুরেদের নিয়ে তাদের কিছু কার্যক্রম আছে। যার সংখ্যাটাও খুব বেশি না। তবে অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছোটমণি নিবাস নামে তাদের একটি কার্যক্রম রয়েছে। পরিত্যক্ত, ঠিকানাহীন, দাবিদারহীন ও পাচারকারীদের নিকট থেকে উদ্ধারকৃত এবং ০-৭ বছর বয়স পর্যন্ত বিপন্ন শিশুদের গ্রহণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণপোষণ, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগসহ লালন-পালনের জন্য ৬ বিভাগে ৬টি ছোটমণি নিবাস রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট অনুমোদিত আসন সংখ্যা ৬০০। এছাড়া ভবঘুরেদের নিয়ে পৃথক কিছু কার্যক্রম রয়েছে।

এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের ভবঘুরে কার্যক্রম শাখার সমাজসেবা অফিসার আবু নাঈম ঢাকা মেইলকে বলেন, ভবঘুরে শাখায় আমাদের অধীনে টোটাল ৭৬৬ জন রয়েছে। তার মধ্যে কিছু পথশিশু থাকতে পারে।

kamlapur
কমলাপুর স্টেশনেই থাহি-ঘুমাই। ঘুম থেইকা উঠি, উইঠা একটা বস্তা নিয়া, বোতল টোকাই। সেগুলা বেইচা ৪০-৫০ টেকা হয়। সেইডা দিয়া সকালে খাই- পথশিশু সাকিব। ছবি: ঢাকা মেইল

শিশুদের শারীরিক, মানসিক বিকাশসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে শিশু একাডেমি। কিন্তু প্রায় ১০ লাখ পথশিশুর বিপরীতে তাদের কার্যক্রম খুবই সামান্য। শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম ঢাকা মেইলকে বলেন, শিশু একাডেমির অধীনে আমাদের শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলো কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে আমরা সুবিধাবঞ্চিত ও যাদের বাবা-মা নেই এমন বাচ্চাদেরকে রাখি। আমাদের শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোতে ৭৫২ জন শিশু আছে। পথশিশুদের কার্যক্রমটা একটু অন্যরকম।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পথেই মারা যায় পথশিশু— এতে যেমন রাষ্ট্রের দায় আছে, তেমনি সমাজেরও অনেকটা দায় আছে। সমাজে বিভিন্নভাবে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ধরুন একটা শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এখন তাকে তো আর কোনো সংগঠন কিংবা সরকার নির্যাতন করছে না। মানুষই আরেকজন মানুষকে নির্যাতন করছে। আমাদের প্রত্যেককে সামাজিক দায়-দায়িত্বটা নিতে হবে। এই দায়-দায়িত্বটা যতদিন রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমরা সামাজিকভাবে না নিতে পারব ততদিন এর সমাধান হবে না।

কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. ইফফাত আরা শামসাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, পথশিশুরা একটা অস্বাস্থ্যকর পারিবেশে বাস করে। ময়লার মধ্যে থাকে। পথের পাশে থাকে। শব্দদূষণ তাদের জন্য ঝুঁকি। ধুলাবালি, প্রতিটা গাড়ি থেকে যে গ্যাস বের হচ্ছে, বায়ুদূষণ তাদেরকে ইফেক্ট করে। তারা ময়লার মধ্যে থেকে খাবার খাচ্ছে। সবই তো স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে পড়ে। এছাড়া পথশিশুদের বড় একটা অংশ মাদকাসক্ত। স্বাস্থ্যগত যেকোনো ইনফেকশন, পলিউশন, মাদকাসক্ত— সবগুলোই তাদেরকে মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

চাইল্ড রাইটস অনুযায়ী শিশু কখনও পথে থাকবে না। শিশু থাকবে অভিভাবকের কাছে অথবা রাষ্ট্রের কাছে— বলছিলেন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে’র কর্মসূচি সমন্বয়ক রাফিজা শাহীন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, রাইটস অনুযায়ী একটি শিশুরও পথে থাকার কথা না। চাইল্ড রাইটসের হিসেবে পথশিশুই থাকতে পারবে না। শিশুর দায়িত্ব পরিবারকে নিতে হবে। পরিবার ফেইল হলে রাষ্ট্রকে নিতে হবে। চাইল্ড রাইটস কনভেনশনে (সিআরসি) বলা আছে, ১৮ বছরের সব শিশুর দায়িত্ব অভিভাবক নেবে, অভিভাবক ফেইল করলে রাষ্ট্রকে নিতে হবে। ২০১৩ সালে শিশু নীতি হয়েছে। সেই নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

ccc
আমাগোরে মশায় ধরে না। হ্যাতির সাথে আমাগেরে ভাব হইয়া গেছে- শিশু রিপন। ছবি: ঢাকা মেইল

শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট চাই

চলতি অর্থবছরে নারী ও শিশু খাতে সরকারের বাজেট প্রায় ৪ হাজার ৭৫৫ কোটি। গেল কয়েক বছরে বাজেটের আকার যেভাবে বেড়েছে সে অনুপাতে এই খাতে বাজেট বাড়েনি। কয়েক বছর ধরেই ফিগারটা প্রায় একই রকম। সেখানে পথশিশুদের জন্য দু-একটি প্রকল্প ছাড়া সুনির্দিষ্ট তেমন বাজেট নেই। তাই প্রায় ১০ লাখ পথশিশুর কল্যাণে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বাজেট।

শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্তমানে শিশুদের জন্য যে বাজেট তা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। বাজেটে শিশুদের বিষয়টা বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

শিশু অধিদফতর গঠন সময়ের দাবি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এরমধ্যে পথশিশু দশ লাখেরও বেশি। কিন্তু শিশুদের জন্য আলাদা কোনো অধিদফতর নেই।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, অনেক শিশু আছে যারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। যার মধ্যে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে। অনেকে কনস্ট্রাকশনের কাজ করে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ আছে, তা খুবই সীমিত। সেটা আরও শক্তিশালী করা দরকার। তাই শিশুদের জন্য আলাদা অধিদফতর সময়ের দাবি। যেখানে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

টিএই/এইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর