বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হতাশা কাটিয়ে পিলুর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প

আসাদুজ্জামান লিমন
প্রকাশিত: ০২ মার্চ ২০২২, ১২:২১ পিএম

শেয়ার করুন:

হতাশা কাটিয়ে পিলুর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প

টানা চারবার গর্ভপাতের পর হতাশায় ডুবে যান ইশরাত শামসাদ পিলু। জীবনের ওপর হারিয়ে ফেলেন আগ্রহ। মা হওয়ার আজন্ম স্বপ্নটা যেনো অধরাই থেকে যাবে! তাই বাঁচার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু চিকিৎসক স্বামী তাকে দমে যেতে দেননি। তার কাঁধে হাত রাখেন আত্মীয়-স্বজনরাও। সবাই হয়েছেন সহমর্মী। দিয়েছেন সুপরামর্শ।

স্বজনদের ভাষ্য ছিল, কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে কেটে যাবে হতাশা। হতাশা কাটাতে কিছু একটা করবেন বলে মনস্থির করেন পিলু। এরই মধ্যে বড় বোন তাকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখান। বলেন, পিলুর রান্নার হাত ভালো। চাইলে সে বাসায় রান্না করে বিক্রি করতে পারে।

সময়টা ২০২০ সাল। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাস করোনায় তখন স্থবির বিশ্ব। সংক্রামক ব্যাধিটি ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশও। সংক্রমণ রুখতে জারি করা হয় বিধিনিষেধ। বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অফিস-আদালত, কলকারখানার দুয়ারও বন্ধ। মানুষ ঘরের বাইরে যেতে শঙ্কিত। এমনই দিনক্ষণে ফেসবুকে ‘পিলুস কিচেন’ (https://www.facebook.com/Piluskitchen) নামে একটি পেজ খোলেন।

chiken saslick

হরেক রকমের খাবারের ছবি দিয়ে পোস্ট দেন। নগরের ঘরবন্দি মানুষ মুখোরোচক সেসব খাবারের ছবি দেখে পিলুকে ফোন দেন। ঘরে বসেই এসব খাবার খেতে চান। তাদের রসনা মেটাতে রান্নাঘরে রাঁধুনী বেসে ঢোকেন পিলু।  আনন্দ নিয়ে রান্নাও করেন। ডেলিভারি ম্যানের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন গন্তব্যে। পিলুর রান্না করা খাবার খেয়ে যারপরনাই তারিফ করেন ক্রেতারা। আর তাইতো পুনরায় অর্ডার করেন।

এভাবেই হতাশা কাটিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন পিলু। নিজের উপার্জিত টাকায় সংসারের এটাসেটা কিনতে পারছেন। পিলুর এই উদ্যোগে খুশি স্বামীসহ আত্মীয়-স্বজনরা।


বিজ্ঞাপন


pilu pizza

পিলু বলেন, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজিনি। তবে কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। উদ্যোক্তা হতে স্বামী ও স্বজনের পরামর্শে অনলাইনে খাবারের ব্যবসা শুরু করি।

‘আমি রান্না করতে পারি। আমার বড় আপুর অনুপ্রেরণাতেই রান্নাকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে আগানো। কারণ রান্না করেও সংসারে সময় দেওয়া যায়। নারীদের জন্য এটা হতে পারে ভালো একটা উদ্যোগ’। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন পিলু। 

pilu frozen food

এই নারী উদ্যোক্তা জানান, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা আসেন উচ্চশিক্ষার জন্য। ভর্তি হন সরকারি ইডেন মহিলা কলেজে। পড়েছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে। বিয়ে হয় তৃতীয় বর্ষে পড়াকালে। বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যান। কিন্তু চাকরি খোঁজেননি। হতে চেয়েছিলেন উদ্যোক্তা।

চিকিৎসক স্বামীর কারণে সংসারের ভার বহনের দায়িত্ব তার কাঁধে কখনো আসেনি। কর্মহীন থাকার কারণে ব্যর্থতা তাকে পেয়ে বসে। হতাশায় ডুবে তলানিতে গিয়ে পড়েন। সেই সময়েই স্বামী ও স্বজনের পরামর্শে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন বোনেন। মাত্র দুই বছরেই মোটামুটিভাবে পিলুস কিচেনকে ঢাকার কিছু মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তার রান্নায় রসনা তৃপ্তি হয়েছে অনেকেরই। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বারবার অর্ডার করেছেন।

পিলু বলেন, ‘আমার ক্রেতাদের বেশিরভাগই পুরোনো। একবার যিনি আমার হোম কিচেনের খাবার খেয়েছেন, তিনি ফের খাওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছেন। দিয়েছেন অর্ডারও।’

pilu frozen food

বর্তমানে পিলুস কিচেনে অর্ডার করে ঘরে বসেই খাওয়া যায় পিৎজা, পিঠা, বিভিন্ন ধরনের রুটি, ফ্রোজেন খাবার এবং চাইনিজ খাবার। কিছু খাবার অর্ডার করার মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে পাওয়া যায়। কিছু খাবারের অর্ডার দিতে হয় আগের দিন। অর্ডার করার জন্য অগ্রিম টাকা দিতে হয় না। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেন পিলু।

খাবারের ওজন ভেদে ডেলিভারি চার্জ নির্ধারিত হয়। ডেলিভারি চার্জ ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।

পিলু বলেন, ‘আমার কিচেনের যাত্রা হয়েছিল পিৎজ্জা দিয়ে। সবার অনুপেরণায় কয়েক মাস পরেই ফ্রোজেন আইটেম এবং চাইনিজ আইটেম শুরু করি। এবং ভালো সাড়া পাই।’ 

এসব খাবার তিনি একাই নিজের হাতে রান্না করেন। সংসার, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে সময় দেওয়ার পর যতটুকু সময় থাকে, সেই সময়টুকু কাজে লাগান রান্নায়। উদ্ভাবনী শক্তিতে কাজ লাগিয়ে মনোনিবেশন করেন হেঁশেলে। 

‘আমি কয়েক পদের রান্না নিজেই পারতাম। মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম। বাকিটা শিখেছি আমার বড় বোনো কাছে।’ বলছিলেন এই এফ-কমার্স নারী উদ্যোক্তা। 

প্রতিদিনই কিছু না কিছু অর্ডার আসে তার। এজন্য অবশ্য ফেসবুক পেজে নিয়মিত খাবারের ছবি ও ওই খাবার সম্পর্কে লিখে পোস্ট দিতে হয়। মেসেঞ্জারে ক্রেতারা নক করলে রিপ্লাই দিতে হয়। যদিও এই কাজ কঠিন নয়। কঠিন কাজটি রান্নার। সেই কাজ তিনি আনন্দ চিত্রেই করেন। আর এভাবেই তিনি হতাশা ভুলে নারী উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। পরিকল্পনা করছেন ভবিষ্যতে একটি ফুড শপ চালু করবেন। যেখানে বিভিন্ন পদের দেশি-বিদেশি স্বাদের খাবার মিলবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে কিছু বেকার তরুণ-তরুণীদের। 

pilu facebook page

পিলু বলেন, করোনার ঢেউ এখনো চলমান। এই সময়ে সবাই চায় ফ্রেশ এবং হাইজেনিক ফুড ঘরে বসে খেতে। আমি ফ্রেশ ফুড হাইজেন মেইনন্টেন কর তৈরি করি। এর জন্য খুব বেশি একটা মুলধনেরও দরকার হয় না। 

পিলু মনে করেন, করোনার কারণে ঢাকায় অনলাইনে খাবার অর্ডার করার প্রবণতা বেড়েছে। তার মতো গৃহিনীরা চাইলে খাবার তৈরি করে অনলাইনে বিক্রিও করতে পারেন। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগও আছে।

এজেড/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর