শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বন্যায় হ্যাম রেডিও অপারেটরদের ত্রাণ সহায়তা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে

অনুপ কুমার ভৌমিক
প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২২, ০২:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

বন্যায় হ্যাম রেডিও অপারেটরদের ত্রাণ সহায়তা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে

‘সিয়েরা টু ওয়ান ট্যাঙ্গো ভিক্টর টু কন্ট্রোল। ট্যাঙ্গো ভিক্টর হো অ্যাহেড। দুই কার্টন খাবার স্যালাইন ও এক বক্স স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে দ্রুত মেডিকেল টিমের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রজার দ্যাট...

বেতারে এই কথোপকথন সুনামগঞ্জে এআরএসবির বেতার যোগাযোগ, ত্রাণ ও চিকিৎসা ক্যাম্পে। সেখানে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি মিশন পরিচালনা করা হয়।   


বিজ্ঞাপন


সুনামগঞ্জে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ, চিকিৎসা ও বেতার যোগাযোগ স্থাপন করা।

arsb২১ জুন সেখানে যাই। আমাদের দলে ঢাকা থেকে ১৫ জন ছিলেন। এরমধ্যে আমি অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি বাংলাদেশের (এরআরএসবি) সাধারণ সম্পাদক। আমার কল সাইন সিয়েরা টু ওয়ান ট্যাঙ্গো ভিক্টর। অন্যদের মধ্যে সংগঠনটির সদস্য ও চিকিৎসরা ছিলেন। 

সংগঠন ও অন্যান্য সহযোগী সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতায় এই ত্রাণ কার্য পরিচালনা করি। 

arsbসিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে, আমরা সেখানে উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেই। 


বিজ্ঞাপন


এজন্য প্রথমে আমাদের সংগঠনের সকল সদস্যদের মতামত নিয়ে ঢাকায় একটি সভা করি। সভায় সিদ্ধান্ত হয় আমরা নিজ অর্থায়নে বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ, চিকিৎসা ও বেতার যোগাযোগ স্থাপনে সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করবো। 

সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে, ‘ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাড রেসপন্স ইউনিট গঠন করা হয়। এই ইউনিটের অধীন তিনটি টিম সাজানো হয়। টিম ১ ছিল ইমার্জেন্সি রেডিও যোগাযোগ, টিম ২ ছিল ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম এবং ৩ নম্বর টিমটি ছিল ইমার্জেন্সি রেসকিউ নিয়ে। 

arsb
 এরপর আমরা সাধারণ সদস্যদের কাছে থেকে আর্থিক সহযোগিত চাই। আমাদের ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে অর্থ সহায়তা চেয়ে নোটিশ দেই। এর পরিপেক্ষিতে প্রায় অর্ধ লাখ টাকা সংগ্রহ হয়। এছাড়াও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য এআরএসবির তহবিল থেকে সহযোগিতা নেওয়া হয়। 

এরই মাঝে আমরা ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাড রেসপন্স ইউনিটের সদস্য এবং কর্মপরিকল্পনা সাজাই। 

arsbএর ভেতরে সদস্যদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ত্রাণ ও চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় ও সংগ্রহের। সকল সামগ্রী সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত বেতার যোগাযোগ সামগ্রী নিয়ে আমরা ২১ তারিখ সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু ওই দিন রাতে বাস ছাড়ার পূর্বে জানতে পারি সুনামগঞ্জের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় ভেঙে পড়েছে। তাই আমরা সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।

আমাদের সবার রিপোটিং টাইম ও স্থান ছিল ২১ তারিখ রাত ১০টা ৩০ মিনিট ঢাকার মহাখালীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। একে একে সবাই সেখানে একত্র হতে থাকেন। একটা সময় দেখা যায়, আমাদের ত্রাণ সামগ্রী টার্মিনালে বিশাল স্তুপ আকার ধারণ করেছে। 

আমাদের মালামাল দেখে এনা পরিবহন কর্তৃপক্ষ এসব মাল বহন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তখন আমরা তাদেরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, অনুরোধ করে এসব মাল বাসে বহন করে নেওয়ার সুযোগ পাই। 

arsbবাস ছাড়ে রাত ১১টা ৪০ মিনিটে। যাত্রা পথ ঢাকা থেকে সিলেট। সারারাত আমরা জার্নি করে সকালে সিলেটের বাস স্ট্যান্ডে নামি। তখন সকাল সাড়ে সাতটা। সবাই মিলে মালামাল বাসের ভেতর থেকে নিচে নামাই। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা খাই। সকালের নাস্তায় ছিল দুটি করে পরোটা একটি করে ডিম ভাজি ও সবজি। 

টিমের সবাইকে নাস্তা করার ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি ও সহযোগী সদস্য সাকিরুল ইসলামকে নিয়ে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য একটি মিনি বাস ভাড়া করার  উদ্দেশ্যে বের হই। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর বাস নিয়ে স্ট্যান্ডে আসি। এরপর সবাই ওই বাসে মালামাল ওঠানোর ফাঁকে সাকিরুল ও আমি সকালের নাস্তা করার অবকাশ পাই। 

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমরা সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করি সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে আমরা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অবলোকন করি। অসংখ্য মানুষকে আমরা সড়কে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেখি। পথে যেতে যেতে বন্যাকেন্দ্রীক সরকারের ত্রাণ কার্যক্রম ও স্বশস্ত্র বাহিনীর তৎপরতা দেখি। 

প্রায় চার ঘণ্টা পর আমরা সুনামগঞ্জ পৌছাই। দেড়টা নাগাদ আমরা সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছাই। কিন্তু আমাদের গন্তব্য ছিল সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত বন্যাকবলিত অঞ্চল দিরাই , জামালগঞ্জ এবং তাহির পুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল। 

arsbশহরে বাস থেকে নামার পর ওই তিন এলাকায় মিশন পরিচালনা করার জন্য কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় পুনরায় ওই বাস নিয়ে আমরা ঢাকা সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কে ফিরতি পথে যাত্রা করি। জহুর সেতু পার হয়ে আরও খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়ে দেখি সামনে যাওয়ার আর কোনো সড়ক নেই এবং সেখান থেকেই ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের জন্য নৌযানে করে বিভিন্ন গন্তব্যে যাচ্ছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। 

আমরা বাস থেকে নামি। নেমে দেখি প্রায় সকল নৌযান ভাড়া হয়ে আছে। আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো ট্রলার পাচ্ছিলাম না। স্থানীয় একজনের সহযোগিতায় অবশেষে একটা ট্রলারের ব্যবস্থা হয়। এরইমাঝে দুপুর প্রায় পার হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সদস্যরা দীর্ঘক্ষণ ভ্রমণ করে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্থ। কিন্তু ওই এলাকায় বন্যাকবলিত হওয়া কোনো খাবারের বন্দোবস্ত ছিল না। শেষে আমাদের দুজন সদস্যকে স্থানীয় একজনের মোটরসাইকেল ভাড়া করে সুনামগঞ্জ পাঠাই। তারা সেখান থেকে থেকে পাউরুটি, কলা ও খাবার পানি সংগ্রহ করে আনেন। 

এদিকে আমাদের ভাড়া করা ছাউনিওয়ালা ট্রলারে মালামাল ওঠানো হয়। আমাদের এখনকার গন্তব্য জামালগঞ্জ উপজেলা। ট্রলারে যাত্রার পূর্বে এআরএসবির নিয়ম অনুযায়ী সকল সদস্য লাইফজ্যাকেট পরিধান করে। যাত্রা শুরু হলো। ট্রলার চলতে শুরু করলে মনে হচ্ছিল যেনো আমরা সমুদ্রে আছি। কোথাও কুল কিনারা নেই। চারদিকে পানি আর পানি। ইতিমধ্যে আমরা দুপুরের খাবার হিসেবে পাউরুটি ও কলা খাই।

arsbবন্যার ক্ষয়-ক্ষতি দেখতে দেখতে আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই নৌপথে পাড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। তখন আমরা নানা উপায়ে, কখনো নিজেরা নেমে, ট্রলার ধরে উঁচু করে জামালগঞ্জ বাজারের দিকে এগিয়ে যাই। কেননা, বাজারে ঢোকার পথে কোথাও সড়ক, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বাড়িঘর ছিল। সেগুলো কৌশলে এড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছাই।

তখন ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা। জামালগঞ্জ থানা ঘাটে ট্রলার নোঙ্গর করা হয়। সেখানে আমরা নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর ত্রাণ কার্যক্রমের কন্ট্রোলরুম দেখতে পাই। তাদেরকে আমাদের পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য জানালে তারা তাদের থাকার অস্থায়ী ক্যাম্পে আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। মালামাল নিয়ে সেখানে উঠি। জায়গাটা বেশ উঁচু। 

ওখানে একটি স্থানীয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। আমরা সেই ক্যাম্পে আমাদের বেজ ক্যাম্প স্থাপন করি। আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল চারটা কক্ষ, ঘুমানোর জন্য চৌকি ও বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। 

arsb
একটি কক্ষে আমরা অস্থায়ী বেতার যোগাযোগ মূল কেন্দ্র স্থাপন করি। ওই স্কুলটি ছয় তলা। ছাদে আমরা এইচএফ, ভিএইচএফ ও ইউএইচএফ অ্যান্টেনা স্থাপন করি। এইচএফ অ্যান্টেনা  ছিল ২০ মিটার ও ৪০ মিটার ইনভারর্টেড ভি অ্যান্টেনা। ইউএইচএফ ও ভিএইচএফের জন্য একটি করে হুইপ ও ইয়াগি অ্যান্টেনা স্থাপন করা হয়।

বেজ কন্ট্রোল স্টেশনে ১০০ ওয়াটের একটি এইচএফ রেডিও ও ২৫ ওয়াটের ইউএইচএফ ও ভিএইচএফ রেডিও বসানো হয়। এসব রেডিওতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আমাদের পোর্টেবল জেনারেটর, ৬০ অ্যাম্পিয়ারের ব্যাটারি প্যাক ও ৪৮ ওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়।

এসব কাজ করতে করতে রাত হয়ে যায়। পরের দিনের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে রাতে মাছ-ভাত খেয়ে ক্লান্ত শরীরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ক্যাম্পে এসব খাবারের আয়োজন করে ‘মেহমান খানা’। 

২৩ জুন খুব ভোরে আমরা ঘুম থেকে উঠি। ফ্রেশ হয়ে সকালের খাবার খাই। সকালের আয়োজন ছিল খিচুড়ি। নৌবাহিনীর সহযোগিতায় ছোট আকারের ট্রলার ভাড়া করি। সেখানে ন্যায্যভাড়ায় ট্রলার মেলে। কিছু ত্রাণ, চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে ১০ জন সদস্যসহ অজানায় যাত্রা করি। বাকিরা কন্ট্রোল স্টেশনে ছিল। 

ওই ট্রলারে ২৫ ওয়াটের ভিএইচএফ ও ইউএইচএফ রেডিও ও ৫ ওয়াটের হ্যান্ডেহেল্ড (ওয়াকিটকি) ব্যবহার করি। বেতার দিয়ে কন্ট্রোলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি। 

arsbআমরা যেতে যেতে বন্যাপীড়িত প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখি মানুষের খাবার ও চিকিৎসার সংকট সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে শিশু, নারী ও বয়স্করা নানা সমস্যায় আক্রান্ত। 

আমাদের দেখে তারা পানি পেরিয়ে হুড়াহুড়ি করে নৌযানের কাছে চলে আসে। তখন আমরা তাদেরকে বলি আপনাদেরকে চিকিৎসা সেবা ও শিশুদের জন্য কিছু শিশুখাদ্য এনেছি। সেগুলো আপনাদের দেবো। ওখানে নেমে একটি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করে ঘন্টা দুয়েক চিকিৎসা সেবা দেই।  ওখানে সাধারণত পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল। এছাড়াও সেখানকার শিশুরা অপুষ্টিহীনতায় ভুগছিল। 

আমাদের মেডিকেল টিম তাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা পরামর্শ, ওষুধ ও নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করে। শিশুদের শিশুখাদ্য ও কিছু ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়। 

সেখানে থেকে পুনরায় ট্রলারে চেপে আরেকটি এলাকায় যাই। সেখানেও অনুরূপ কার্যক্রম পরিচালনা করি। ওই দিন এরকম আরও কয়েকটি জায়গায় গিয়ে একই কার্যক্রম পরিচালনা করে সন্ধ্যায় বেজ ক্যাম্পে ফিরে আসি। সেদিন কাজের চাপে আমাদের দুপুরের খাওয়ার ফুসরত মেলেনি। ক্যাম্পে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ভাত, মাংস দিয়ে রাতের আহার করি। 

arsbরাতে বাংলাদেশসহ নেপাল, ভারত, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাদেরকে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাই। আমরা ২০ মিটার ও ৪০ মিটার ব্যান্ডে এইচএফ রেডিওতে যোগাযোগ করি।  

বাংলাদেশে কথা হয় সিয়েরা টু ওয়ান হোটেল আলফার সঙ্গে। তখন তখণ পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থান করছিলেন। ওনার হ্যান্ডহেল্প নেম আশরাফুল মোমেন খান। তিনি আমাদের কাছ থেকে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্তিতি সম্পর্কে জানেন। এবং আমাদের বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে জ্ঞান দেন। 

ভারতের আসামের একজন অপারেটরের সঙ্গে  এইচএফ রেডিওতে যোগাযোগ হয়। তিনি জানান, সে সার্বক্ষণিকভাবে আসামের বন্যা পরিস্থিতির ওপরে নজর রাখছেন। এ বিষয়ে আমাদেরকে রেডিওতে সার্বক্ষণিক তথ্য প্রদান করেন। 

arsb২৪ জুন খুব ভোরে নৌবাহিনীর কন্ট্রোল রুম থেকে আমাদের কাছে অনুরোধ আসে, দ্রুত কন্ট্রোল রুমে একটি মেডিকেল টিম পাঠানোর। দুইজন চিকিৎসককে নিয়ে আমি সেখানে যাই। গিয়ে দেখি অনুমানিক সাত বছরের একটি ছেলে শিশু প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় আছে। তাকে স্থানীয় সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে প্রেরণ করতে বলা হয়েছে। 

তখন আমরা স্থানীয়ভাবে তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে একজন চিকিৎসক ও নৌবাহিনীর সদস্যসহ বাহিনীর রেসকিউ বোটে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সুনামগঞ্জ থেকে সেই অসুস্থ শিশুটিকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয়। 

এরপর নাস্তা করে আমরা একটি বড় একটি নৌযান ভাড়া করি। এই নৌযানটি ভাড়া করার জন্য আগের দিন রাতেই কথা বলে রাখি। 

arsbএই নৌযানটিকে আমরা ফ্লোন্টিং কমান্ড সেন্টার বানাই। এই ফ্লোটিং কমান্ড সেন্টারে আমাদের তিনটি টিমই ছিল। ওইদিন আর বেজ স্টেশন বলতে কিছুই ছিল না। এই ভাসমান কমান্ড সেন্টারের ভেতরেই এইচএফ, ইউএইচএফ ও ভিএইচএফ রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হয়। এই বোটটিকে কন্ট্রোল সেন্টার বানিয়ে আরও ছোট ছোট কয়েকটি বোটে টিম সাজিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসা ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ হয়। 

কন্ট্রোল বোট থেকে বেতারের মাধ্যমে অন্যান্য টিমকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। কয়েকটি দেশের সঙ্গে বোট থেকেই এইচএফ রেডিওতে যোগাযোগ হয়।  

এদিন আমরা প্রায় সহস্রাধিক বন্যাদুর্গত মানুষকে চিকিৎসা দেই। কয়েকটি এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য প্রশিক্ষণ ও বিশুদ্ধকরণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। 

arsbসেদিন বেজ ক্যাম্পে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ওদিনও দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি। ক্যাম্পে ফিরে আমরা ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। রাতের খাবার খেয়ে বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে রেডিওতে যোগাযোগ করি। তাদেরকে আজকের কার্যক্রম সম্পর্কে বলি।

কন্ট্রোল রুম ও রেডিও যোগাযোগে মূখ্য দায়িত্বে ছিলেন-সিয়েরা টু ওয়ান ইকো ডেল্টা। তাকে সহযোগিতা করার জন্য ছিলেন, এআরএসবির সহযোগী সদস্য এআরকে রিপন।

আমাদের এই পুরো মিশনে আমাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা আমাদের প্রতিদিনের ত্রাণ, চিকিৎসা কার্যক্রমের সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করেছে। 

arsb২৫ জুন আমরা মিশন আমরা ঘুম থেকে উঠে আমাদের অবশিষ্ট ত্রাণ সামগ্রী, বিশেষ করে পানি বিশুদ্ধকরণ সামগ্রী নৌবাহিনীর সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণসহ বুঝিয়ে দেই। যাতে পরিস্থিতি যদি খারাপ হয় তবে তারা যেনো সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। এবং স্থানীয় দুইটি ত্রাণ শিবিরে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আনুমানিক ১২ টার দিকে আমরা সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। 

বলে রাখা ভালো, আমরা যখন দুর্গত এলাকা থেকে ক্যাম্পে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন আমাদের মেডিকেল টিমের সদস্যরা স্থানীয় ত্রাণ শিবিরের অসুস্থদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছে।

সুনামগঞ্জে পৌছাই আড়াইটা নাগাদ। সেখানে পৌছে আমি ও রাকিব সবার জন্য হোটেল থেকে খাবার কিনে আনি। রাস্তার পাশের দাঁড়িয়ে দুপুর খাবার খাই। 

arsbএরপর ঢাকায় ফেরার জন্য বাসে উঠি। এনা পরিবহনের ওই বাস সিলেট হয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা করে। ঢাকায় পৌঁছাই প্রায় মধ্যরাতে।

দেশের যেকোনো দুর্যোগে অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা এই ধরনের মিশন পরিচালনা করে থাকে। 

আমাদের এক নম্বর টিম ছিল ইমার্জেন্সি রেডিও যোগাযোগ নিয়ে। ওই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন এআরএসবির জয়েন্ট সেক্রেটারি সিয়েরা টু ওয়ান ইকো ডেল্টা। যার হ্যান্ডেহেল্ড নেম সৈয়দ শামসুল আলম তুহিন। ডেপুটি টিম লিডার ছিলেন এআরকে রিপন।   
 
দুই নম্বর টিম ছিল  ইমার্জেন্সি মেডিকেল নিয়ে। এই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন ডা. জামি। ডেপুটি ছিলেন আরেকজন চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে আরও ছয়জন চিকিৎসক ছিলেন।  

arsbতিন নম্বর টিমটি ছিল ইমার্জেন্সি রেসকিউ। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন-সিয়েরা টু ওয়ান ব্রাভো কিলো। হ্যান্ডহেল্ড নেম জুবায়ের আল বেলাল। ডেপুটি ছিলেন, এআরএসবির সহযোগী সদস্য রাকিব হাসান। 

আমাদের এই মিশনের নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তার নাম না বললেই নয়। তিনি নৌ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শফিক। সে দুর্যোগকালে জামালগঞ্জ উপজেলার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ছিলেন। 

কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা মতো, মিশনের দ্বিতীয় দিনে ত্রাণ নিতে এসে একটি মেয়ে শিশু পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছিল। আমাদের রেসকিউ টিমের সদস্যরা তাকে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারে করে। এমন ছোটখাটো অনেক ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু সব কিছু এখন মনেও নেই। 

arsbএ মিশনে গিয়ে আমরা অবলোকন করেছি, সঠিক তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ত্রাণ সামগ্রী সঠিক স্থানে, দুর্গতদের হাতে পৌঁছায়নি। 

আমাদের পরামর্শ, এই ধরনের দুর্যোগে মানুষকে সহযোগিতা করতে চাইলে সর্বপ্রথম সঠিক পরিকল্পনা ও সঠিক মানুষকে নিয়ে টিম গঠন করা জরুরি। সেদিক বিবেচনা করলে এআরএসবির টিম গঠন, কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম অন্যান্যদের থেকে অনেক অনেক গুণ এগিয়ে ছিল। 

এআরএসবি আগামীতে এই ধরনের জাতীয় দুযোর্গে সবার সহযোগিতা নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়, সহযোগিতা করতে চায়। 

arsbদেশের স্বার্থে, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত উন্নত জাতি গঠনে অ্যামেচার রেডিওর ভূমিকা অপরিহার্য।  সারা বিশ্বে অ্যামেচার রেডিওর ক্ষেত্রে বলা হয়, যে দেশে যত অ্যামেচার রেডিও অপারেটর সে দেশ তত উন্নত। এজন্য উন্নত যুব সমাজ গঠনে নিয়মিত অ্যামেচার রেডিও পরীক্ষার আয়োজন করার জন্য সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আহ্বান রইল। 

৭৩

লেখক:

অনুপ কুমার ভৌমিক
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি
কল সাইন-S21TV

অনুলিখন: আসাদুজ্জামান লিমন, কল সাইন-S21LE

এজেড 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর