প্রকৃতির এক বিস্ময়কর লীলাভূমি নরওয়ের আকাশ যেন বর্তমানে কোনো এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা ক্যানভাস। সম্প্রতি গত ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর নরওয়ের লফোটেন দ্বীপপুঞ্জের রেইন এলাকায় রাতের আকাশে দেখা মিলেছে অভূতপূর্ব এক আলোর নাচন। উত্তর মেরুর আকাশে এই রঙিন আলোর ঝলকানি মূলত 'মেরুজ্যোতি' বা 'সুমেরুপ্রভা' নামে পরিচিত, যা আন্তর্জাতিকভাবে 'অরোরা বোরিয়ালিস' বা 'নর্দার্ন লাইটস' নামেও সমাদৃত। শীতের এই সময়ে নরওয়ের পরিষ্কার আকাশে সবুজ, বেগুনি ও গোলাপি রঙের এই আলোকচ্ছটা পর্যটক ও আলোকচিত্রীদের মুগ্ধ করছে।
রহস্যময় সুমেরুপ্রভার নেপথ্য কারণ
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞানের ভাষায় সুমেরুপ্রভা হলো পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ও সূর্য থেকে আসা চার্জিত কণার এক চমৎকার মিথস্ক্রিয়া। সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত ইলেকট্রন ও প্রোটনের মতো অসংখ্য চার্জিত কণা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। যখন এই কণাগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাসের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখনই আকাশে এমন রঙিন আলোর জন্ম হয়। বায়ুমণ্ডলের কোন গ্যাসের সঙ্গে এই সংঘর্ষ ঘটছে এবং কণার গতি কেমন, তার ওপর নির্ভর করে এই আলোর রং সবুজ, লাল কিংবা বেগুনি হয়ে থাকে। সাধারণত শীতকালে সূর্যের সক্রিয়তা বেশি থাকলে এই দৃশ্য আরও উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নিশীথ সূর্যের দেশ ও পোলার নাইটের বৈচিত্র্য
নরওয়ের আকাশ মানেই বৈচিত্র্যের মেলা। শীতকালে যেমন সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মেরুজ্যোতির দেখা পাওয়া যায়, তেমনি নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে 'পোলার নাইট' বা মেরু রাত্রি। এই সময়ে সূর্য দিগন্তের ওপরে ওঠে না বললেই চলে, যা মেরুজ্যোতি দেখার জন্য উপযুক্ত অন্ধকার পরিবেশ তৈরি করে। আবার গ্রীষ্মকালে দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত নরওয়েতে সূর্য কখনো অস্ত যায় না, যাকে বলা হয় 'মধ্যরাতের সূর্য' বা 'মিডনাইট সান'। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণেই নরওয়েকে 'নিশীথ সূর্যের দেশ' বলা হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: বিরল সূর্যগ্রহণ: ৬ মিনিট অন্ধকারে ডুবে যাবে পৃথিবী!

হেসডালেন উপত্যকার অমীমাংসিত রহস্য
নরওয়ের আকাশের আকর্ষণ কেবল মেরুজ্যোতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশটির হেসডালেন উপত্যকায় মাঝেমধ্যেই দেখা যায় রহস্যময় আলোর গোলক, যা 'হেসডালেন লাইটস' নামে পরিচিত। উজ্জ্বল এই আলোর পিণ্ডগুলো আকাশে ভাসতে দেখা যায়, যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আজও পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। এছাড়া লফোটেন দ্বীপপুঞ্জের মতো দূষণমুক্ত ও পরিষ্কার আকাশ থেকে রাতের বেলা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ এবং উল্কাপাতের মতো মহাজাগতিক দৃশ্যগুলো অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য
মেরুজ্যোতি বা সুমেরুপ্রভা দেখার জন্য নরওয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা গন্তব্য। ট্রোমসো, উত্তর কেপ এবং লফোটেন দ্বীপপুঞ্জের মতো স্থানগুলোতে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন প্রকৃতির এই জাদুকরী আলো দেখতে। নরওয়ে ছাড়াও আলাস্কা, কানাডা, আইসল্যান্ড এবং সুইডেনের মতো উত্তর মেরুর নিকটবর্তী দেশগুলো থেকেও এই দৃশ্য উপভোগ করা যায়। তবে এবারের বড়দিনের আগে নরওয়ের আকাশে দেখা যাওয়া এই বিশেষ আলোকছটা যেন উৎসবের আনন্দে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এজেড

