শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কতটা সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হবে বুয়েটের ই-রিকশা, কবে আসছে বাজারে?

মো. আব্দুস সবুর (লোটাস)
প্রকাশিত: ২৬ জুন ২০২৫, ১০:০০ এএম

শেয়ার করুন:

কতটা সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হবে বুয়েটের ই-রিকশা, কবে আসছে বাজারে?

হাইড্রোলিক ব্রেক, যাত্রীদের নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী একটি নতুন মডেলের ই-রিকশা তৈরি করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল। নকশাকারী দল জানায়, বর্তমানে যেসব রিকশা বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেটির মতোই দাম হবে নতুন এই রিকশার। তবে বাজারের রিকশার তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ ও আধুনিক ফিচার থাকবে এটিতে।

২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) অর্থায়নে বুয়েটের দলটি নতুন ডিজাইনের ই-রিকশা তৈরির ব্যাপারে কাজ করে আসছে। আগের সরকার সেটির ব্যাপারে গুরুত্ব না দিলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটি বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারে কাজ করছে বলে জানান গবেষক দলের প্রধান ও বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসান।


বিজ্ঞাপন


গবেষক দলের প্রধান বলেন, কোভিডপরবর্তী সময়ে আমরা দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আগে রিকশার তথ্য সংগ্রহ এবং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করি। তবে বাজারের রিকশাগুলো তৈরির কোনো আদর্শ ফিচার নেই। তাই বাজারের রিকশার দুর্বলতা চিহ্নিত করে আমরা ইউনিফাইড একটা ডিজাইন করি।

গবেষণা দলে আরও ছিলেন বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এ সালাম আকন্দ ও মো. আমান উদ্দীন, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান এবং গবেষণা প্রকৌশলী হিসেবে ছিলেন মো. আসাদুজ্জামান ও আবদুল আজিজ ভুঁইয়া।

নতুন নকশার রিকশায় যা যা থাকছে
বর্তমানে যেসব রিকশা রাস্তায় চলাফেরা করে এটির মতোই বুয়েটের করা নতুক রিকশা। গবেষক দল জানায়, সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার রিকশা দেখে প্রায় ১২টি দুর্বলতা শনাক্ত করে তারা। সেগুলো চিহ্নিত করে আরও নিরাপদ ও সাশ্রয়ী করা হয়েছে। এই রিকশার দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ দেড় মিটার এবং উচ্চতা ২ দশমিক ১ মিটার। সব মিলিয়ে আকার হবে এখনকার রিকশার মতোই। রিকশাটি ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন সহজেই বহন করতে পারবে। ফলে দুজন যাত্রী নিয়ে চালক সহজেই রিকশাটি চালাতে পারবেন।


বিজ্ঞাপন


গবেষণা দলের সদস্যরা আরও জানান, নতুন এই রিকশার সবচেয়ে উন্নত ফিচার হলো হাইড্রোলিক ব্রেক। যা অন্য সাধারণ রিকশায় নেই। ফলে এই রিকশার নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হবে। এছাড়া লুকিং গ্লাস, ইন্ডিকেটর থাকবে। যা বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাবে। 

নতুন রিকশায় ছাউনি ও কাচের ‘উইন্ডশিল্ড’ থাকবে। ফলে বৃষ্টিতে চালক ও যাত্রীদের ভিজতে হবে না। নতুন রিকশায় কাঠামোর সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত করা হয়েছে হেডলাইট (মূল বাতি), যাতে রাস্তার দৃষ্টিসীমা ঠিক থাকে। নতুন হেডলাইটে ‘হাই বিম’, ‘লো বিম’ ও ‘ডিআরএল’ (ডে টাইম রানিং ল্যাম্প) যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এই বাতি চালককে সড়কে চলাচলের সময় দেখতে এবং রিকশাটিকে অন্য যানবাহনের চালকের দৃষ্টিগোচর করতে সহায়তা করবে।

রিকশার দাম যেমন হবে
বুয়েটের তৈরি নতুন নকশার দাম বাজারের রিকশার তুলনায় একটু বেশি হবে। কারণ এই রিকশায় বাজারের তুলনায় রিকশার চেয়ে বেশি কিছু ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। তবে দাম খুব বেশিও হবে না। সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে গ্রাহকরা রিকশা কিনতে পারবেন।

অধ্যাপক মো. এহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, বাজারে তৈরি রিকশার কোনো ফরমেট নেই। যত অল্প খরচে তৈরি করা যায়। এতে রিকশার নিরাপত্তাসহ কোনো বিষয়ই তেমন গুরুত্ব পেত না। কিন্তু আমরা একটি বাহন হিসেবে সেটির সেফটি ও বিভিন্ন ভারসাম্য বজায় রেখে তৈরির কাজ করেছি। ফলে বাজারের তুলনায় একটু বেশি হয়ত হবে। কিন্তু এটি টেকসই ও সাশ্রয়ী হবে।

নতুন রিকশার গতি কেমন হবে
নতুন এই রিকশা প্রায় ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। এই রিকশার নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে এটির বেশি গতি উঠতে না পারে। কারণ হাইড্রোলিক ব্রেক দিয়ে এই গতির চেয়ে বেশি গতির বাহন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ফলে সেভাবেই নতুন রিকশার নকশা করা হয়েছে। এছাড়া ব্রেক করার পরই ব্যাটারির সঙ্গে মোটরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে। এতে করে যেমন বিদ্যুৎ বাঁচবে তেমনি গাড়ির নিয়ন্ত্রণও ভালো হবে।

অধ্যাপক এহসান বলেন, বাজারের রিকশাগুলোর গতির সঙ্গে ব্রেকের সেভাবে ভারসাম্য নেই, তাই দুর্ঘটনা বেশি হয়। তবে আমাদের রিকশা খালি ও যাত্রী থাকা অবস্থায় ৩০ কিলোমিটার গতির বেশিতে চলতে পারবে না। আর রয়েছে ভালো ব্রেক ফলে অন্যান্য রিকশার তুলনায় এটি নিরাপদ হবে।

বাজারে আসবে কবে
দেশের বেশ কিছু বড় কারখানা প্রাথমিকভাবে নতুন নকশার রিকশা তৈরি করে গবেষক দলের কাছে পাঠিয়েছে। বর্তমানে গবেষক দল তাদের তৈরি পাঠানো রিকশাগুলো পরীক্ষা করছে। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে দেশের কিছু কারখানাকে বাণিজ্যিকভাবে রিকশা তৈরির অনুমোদন দেওয়া হবে। তবে ম্যাস প্রোডাকশনের জন্য অনেক সরঞ্জামের প্রয়োজন, তাই হয়ত চলতি বছরের শেষে নতুন নকশার রিকশা বাজারে আসবে।

যেসব কারখানা রিকশা তৈরি করবে তাদের নাম ও প্রতিটি রিকশার একটি স্বতন্ত্র নম্বর থাকবে। এই নম্বর দিয়ে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হবে। এছাড়া চলাচলের সময় কোন কারখানার রিকশা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সেটিও চিহ্নিত করা যাবে।

বুয়েট অধ্যাপক এহসান বলেন, বাংলাদেশে যেহেতু গত প্রায় ১০ বছর ধরে বিভিন্ন ছোট-বড় কারখানা ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি করে আসছে তাই আমরা এমন নকশা করেছি, যাতে সহজেই সেটি তৈরি করা যায়। এতে রিকশার যে দৌরাত্ম সেটি কমে একটি ইউনিফাইড ডিজাইনের রিকশা সারাদেশে চলবে। এই রিকশার ব্যাটারিও শক্তিশালী করা হয়েছে। যাতে মাত্র আড়াই টাকা খরচে এক কিলোমিটার পথ যেতে সক্ষম হয়।

তিনি আরও বলেন, পরীক্ষায় যেসব কারখানার রিকশা পাস করবে সেই কারখানাগুলোকে শুধু বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হবে। এতে করে নতুন এই রিকশা কিনে সহজেই গ্রাহকরা লাইসেন্সও করে নিতে পারবেন।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, বর্তমানে এই রিকশার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে একটি ইউনিফাইড ডিজাইনের রিকশা বাজারে এলে দেশি শিল্প হিসেবেও এটি অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। ভবিষ্যতে আরও মোডিফাই করে কিছু ফিচার বাড়ালে বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। তখন এটি শুধু দেশের বাজারে নয়, বিদেশেও রফতানি করা যেতে পারে বলে মনে করেন বুয়েট অধ্যাপক। 

এএসএল/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর