শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইন্টারনেট ‘ব্ল্যাকআউটে’ ফ্রিল্যান্সিংয়ে বড় ধাক্কা

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২৪, ১১:২৬ এএম

শেয়ার করুন:

ইন্টারনেট ‘ব্ল্যাকআউটে’ ফ্রিল্যান্সিংয়ে বড় ধাক্কা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় বন্ধ ছিল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা। টানা সাত দিন পর ব্রডব্যান্ড এবং ১০ দিন পর মোবাইল ইন্টারনেট ফিরে এলেও এর ধীরগতি ভোগাচ্ছে ফ্রিল্যান্সারদের। এর ফলে বড় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি এক দশকে গড়ে তোলা রেপুটেশন ধ্বংসের শঙ্কা করছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা।

বাংলাদেশে বর্তমানে কয়েক লাখ ফ্রিল্যান্সার আছেন, যারা বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করেন। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং বেকার সমস্যা সমাধানেও অনেকটা অবদান রাখছে।


বিজ্ঞাপন


অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের (ওআইআই) সম্প্রতি একটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং সেবা প্রদানকারী দেশ। সারাবিশ্বের মোট ফ্রিল্যান্সিং সেবার ১৬ শতাংশই বাংলাদেশিরা দেয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সংঘাত-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গত ১৭ জুলাই রাতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যায়।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেদিন মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে আগুন দেওয়া হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়কের ওপর থাকা ইন্টারনেট সেবাদাতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তার। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েকটি ডেটা সেন্টারও। সে কারণেই সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায় বলে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান।

মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মোবাইলে আর্থিক লেনদেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসের প্রিপেইড কার্ড রিচার্জ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাহকরা। কোথাও কোথাও ব্যাংকের এটিএম বুথও বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ইন্টারনেট না থাকায় স্থবির হয়ে পড়ে ই-কমার্স, পোশাক খাতসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্ধ থাকে বন্দরের কার্যক্রম। ইন্টারনেটভিত্তিক সব ধরনের সংবাদ সেবাও অচল হয়ে পড়ে।


বিজ্ঞাপন


২৩ জুলাই রাতে ফেরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। আর দশ দিন পর গত রোববার বিকেলে মোবাইল ইন্টারনেট খুলে দেয় সরকার। কিন্তু ইন্টারনেটে গতি না ফেরায় কাজ করতে পারছেন না ফ্রিল্যান্সাররা।

তারা বলছেন, নেটওয়ার্কহীন দিনগুলোতে ক্লায়েন্টদের কাজ বুঝিয়ে দিতে না পারা ও যোগাযোগ করতে না পারায় তারা কাজ হারিয়েছেন। অগ্রিম পাঠানো অর্থ ফেরত নিয়েছেন অনেকে। এছাড়া সঠিক সময় কাজ না পাওয়ায় বাজে রিভিউ দিয়েছেন বা ফ্রিল্যান্সিং প্লাটফর্মে অভিযোগ করেছেন অনেক ক্লায়েট। ফলে ভবিষ্যতে কাজ না পাওয়ার শঙ্কা করছেন অনেক ফ্রিল্যান্সার।

ঢাকার বাসিন্দা ইয়াহিয়া আমিন ২০২০ সাল থেকে কাজ করছেন ইন্টারনেটে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট বা মার্কেটপ্লেস ফাইবারে। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটের প্রভাবের বিষয়ে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘আমি ২০২০ সাল থেকে ফাইবার মার্কেট প্লেসে কাজ করছি। এই প্লাটফর্মে আমি গ্রাফিকস ডিজাইন সেক্টরে কাজ করি। আমার ২৫টি ক্লায়েন্ট বুক ছিল। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কারণে আমি তাদেরকে সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এই পাঁচদিনে কাজ না দিতে পারায়, কিছু গ্রাহক আমার কাছে অর্থ রিফান্ড চেয়েছে। আমি সাতজন ক্লায়েন্টকে প্রায় ১২৫০ ডলার রিফান্ড করেছি। অনেক ক্লায়েন্ট বিনা নোটিসে কাজ ঝুলিয়ে রাখার জন্য ও সঠিক সময়ে না দিতে পারায় আমাকে ওয়ান বা টু স্টার রিভিড দিয়েছে। ফলে আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বেশ কয়েকজন কাস্টমার আমার বিরুদ্ধে মর্কেট প্লেসে অভিযোগ বা কেইস ফাইল করেছে।’

আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার একাউন্ট এখন রেস্ট্রিকশনে রয়েছে। এমনকি একাউন্ট সাসপেন্ড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এটা আমার একটা একাউন্টের অবস্থা। যারা ব্যবসা হিসেবে কাজ করে, তাদের একাধিক একাউন্ট থাকে। কারও দশটা একাউন্ট থাকলে তার অর্ধেকের বেশি সাসপেন্ডের ঝুঁকিতে। যারা কাজে সক্রিয় ছিল তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।’

নাহিদ ইসলাম নামে আরেক ফ্রিল্যান্সার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধের আগে দিন নতুন চারটি কাজ নিয়েছিলাম, যা আমি ও আমার অপর দুই পার্টনার মিলে ৫ দিনের মধ্যে করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় গ্রাহকের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি। ফলে কাজগুলো সঠিক সময়ে জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি। গ্রাহক নেগেটিভ রিভিউ দিয়ে চলে গেছে। এতে আমার একটা বড় অংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি সামনে কাজ পেতেও আমাকে ঝামেলায় পড়তে হবে। নেতিবাচক রিভিউ থাকলে ক্লাইন্টরা কাজ দিতে চায় না।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের প্রোফাইল ও বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সার গ্রুপগুলোতেও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় ফ্রিল্যান্সারদের।

তারিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি একজন ফ্রিল্যান্সার ওয়েব ডেভেলপার। গত কয়েক দিন নেট না থাকায় সঠিক সময়ে কাজ দিতে পারিনি। বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারিনি। ফলে নেতিবাচক অভিযোগে তিলে তিলে গড়া লেভেল ২ সেলার আইডি ডিজেবল হয়ে গেছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। কীভাবে দ্রুত নতুন করে শুরু করব জানি না।’

শামিম রেজা নামে একজন বলেন, ‘আপওয়ার্ক থেকে ৫টা অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে। পার্মানেন্ট তিনটা কোম্পানিতে ভালো স্যালারিতে জব করতাম। একূল-ওকূল সব হারিয়ে হতাশ। আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’

অনেক ব্যবহারকারী বায়ারের নেতিবাচক কমেন্ট ও ওয়ান স্টার রিভিউয়ের স্কিনশট দেখান। তবে এর মধ্যে কিছু সচেতন বায়ারের মন্তব্যও চোখে পড়েছে, যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ফ্রিল্যান্সারের প্রতি সমবেদনা ও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও কাজের তাগিদে অনেকে তারাও অর্ডার অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।

দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হবে আইটি খাত

ক্ষতির বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি চেয়ারম্যান তানজিবা রহমান গণমাধ্যমকে জানান, ‘খুব খারাপ অবস্থা। ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি যদি আগে জানানো হতো, তাহলে সে অনুযায়ী দ্রুত ফ্রিল্যান্সার ও গ্রাহকদের সতর্ক করে ই-মেইল বার্তা পাঠানো যেত। ফলে ফ্রিল্যান্সাররা সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকেরাও জানতে পারতেন, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারে সমস্যা হতে পারে। সে সুযোগও পাওয়া যায়নি। এখন আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের রিভিউ কমে যাবে। আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের রিভিউ কমে সব কাজ চলে যাবে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে।’

এশিয়া জোনের বাংলাদেশ ফাইভার কমিউনিটির প্রধান মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা খেল। এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে একজন ফ্রিল্যান্সারের জন্য ঘুরে দাঁড়ানো কষ্টকর হবে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগবে। গ্রাহকেরা বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অপেক্ষা করবে না। তাদের দরকার কাজ, তারা অন্য জায়গায় চলে যাবে।’

এমএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর