বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ফগ ক্যাচার: কুয়াশাকে পানিতে রূপান্তরের অভিনব প্রযুক্তি

নিশীতা মিতু
প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২২, ১২:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ফগ ক্যাচার: কুয়াশাকে পানিতে রূপান্তরের অভিনব প্রযুক্তি

প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের মরুভূমির দেশ পেরু। যার রাজধানী লিমা। বিশ্বের অন্যতম শুষ্ক শহর। ১ কোটিরও বেশি মানুষের বাস লিমাতে। যাদের কাছে একসময় বিশুদ্ধ পানি ছিল অমাবস্যার চাঁদের মতো। পানির কষ্ট যারা অনুভব করছিল তীব্রভাবে। প্রযুক্তির এক নয়া আবিষ্কার তাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে। প্রকৃতি থেকে পানি সংগ্রহের এক অভিনব পন্থা খুঁজে বের করেন তারা। যা বদলে দেয় পুরো লিমার জীবনযাত্রা।  

মরুর শহরের  আবহাওয়া তপ্ত। দূষিত পরিবেশ লিমার মানুষদের নিত্য সঙ্গী। কঠিন আবহাওয়ায় নিকটতম উৎস (কুয়া, ঝর্ণা) থেকে পানি সংগ্রহ করতে এখানকার নারীদের প্রতিদিন সাড়ে তিন ঘণ্টা হাঁটতে হতো। বর্তমানে সেই কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে। এখন তারা ফগ ক্যাচারের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করেন।  


বিজ্ঞাপন


fogফগ ক্যাচার কী? 

ফগ মানে কুয়াশা। ক্যাচার মানে যে ধরে বা ধারণ করে। ফগ ক্যাচার এমন একটি প্রযুক্তি যা কুয়াশাকে ধরে রাখে। সহজভাবে বললে, বাতাসে উড়ে বেড়ানো কুয়াশাকে বন্দি করে বিন্দু বিন্দু পানিতে পরিণত করে এই প্রযুক্তি। কুয়াশার ক্ষুদ্র কণাগুলো প্লাস্টিকের চিকন রশি দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি জালে আটকা পড়ে। যা ফগ কালেক্টর বা ফগ নেট নামে পরিচিত। এই জাল বা নেটে কুয়াশা জমা হয়। বিন্দু বিন্দু কুয়াশা জালে আটকে নিচের দিকে চুঁইয়ে পড়ে। জমা হয় পাত্রে। এই পানি বিশুদ্ধ। সুপেয়। যা ওই এলাকার মানুষের তৃষ্ণা মেটায়। চাষাবাদেও ব্যবহৃত হয়। 

শুরুটা যেভাবে

ফগ ক্যাচারের সঙ্গে লিমাবাসীকে যে মানুষটি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি আবেল ক্রুস। কুস্কোর পেরু অঞ্চলের কাছে থাকতেন তিনি। ছোটবেলায় ক্রুসকে রোজ প্রায় এক ঘণ্টার বেশি হাঁটতে হতো, সবচেয়ে কাছের পানির উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে বাড়িতে আনার জন্য। পানির কষ্ট সবসময় ভাবাতো তাকে। বর্ষাকালে তিনি খেয়াল করেন বৃষ্টির ফোঁটা কলা পাতায় জমে। ক্রুস আর তার বাবা মিলে মাটি খুঁড়ে সরু ড্রেন তৈরি করেন। ড্রেনের ভেতরে কলা পাতা বিছিয়ে দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা পানি সংগ্রহে সফলও হন। তবে প্রথম জমা হওয়া পানি ছিল কিছুটা নোংরা। তারপরও ওই পানি থালাবাসন ধোয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল। 


বিজ্ঞাপন


waterকিন্তু কলা পাতা দুই সপ্তাহের বেশি টেকে না। তাই তারা বাঁশ কেটে সেগুলো ড্রেনে স্থাপন করেন।  এটি অনেকদিন টেকে এবং তারা পানি সংগ্রহে সক্ষম হন। এভাবেই পানি সংগ্রহ করার উপায়ের সূচনা করেন ক্রুস।  

বর্ষাকালে না হয় এভাবে পানি সংগ্রহ করা গেল। কিন্তু অন্য সময়? এই ভাবনা মাথায় রেখেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন ক্রুস। দরিদ্র পরিবার নিয়ে লিমায় বাস করতেন তিনি। জমি চাষ করতেন। এক কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় নতুন এক আলোর দিশা পান ক্রুস। প্লাস্টিকের জাল দিয়ে ঘেরা ছিল তার জমি। তিনি খেয়াল করেন এই জালের নিচে পানির অনেক বিন্দু জমেছে। বিশেষ করে পূর্বদিক থেকে যে বাতাস আসতো সেদিকে। জালের নিচে একটি পাত্র রাখেন তিনি। পরদিন সকালে এসে দেখেন স্বচ্ছ পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে পাত্রটি। আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়েন ক্রুস। প্লাস্টিকের জাল দিয়ে প্রকৃতির কুয়াশাকে পানিতে রূপান্তর করার বুদ্ধি আসে তার মাথায়। 

fog catcherফগ ক্যাচারে যেভাবে পানি মেলে

ফগ ক্যাচার মূলত তিনটি অংশ দিয়ে গঠিত। ফ্রেম বা কাঠামো, প্লাস্টিকের জাল, সরু পাইপ। স্টিল, বাঁশ কিংবা কাঠ দিয়ে এর ফ্রেম তৈরি করা হয়। এই ফ্রেমের ভেতর লাগানো হয় প্লাস্টিকের চিকন রশি দিয়ে তৈরি জাল। সমতল থেকে কিছুটা ওপরের দিকে বাতাসের বিপরীত দিকে লম্বা করে এই জালসহ এই ফ্রেম স্থাপন করা হয়। ফ্রেমের খুঁটি  মাটিতে পোতা হয়। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয় জালটিকে। ফলে এটি স্থির থাকে। পুরো বিষয়টিকে আমাদের দেশের নৌকার পালের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

ফ্রেমের নিচের দিকে যেখানে জালের প্রান্তগুলো শেষ হয়েছে সেখানে এক টুকরো লম্বা পাইপ কেটে বসানো হয়। কুয়াশা এসে এই জালে আঁটকায়। যা পানির ফোঁটায় রূপান্তরিত হয় পাইপে জমা হয়। ওই পাইপের পানি গিয়ে জমা হয় একটি বড় ট্যাঙ্কে। এভাবে জালে জমা কুয়াশা পানি হয়ে ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়ে ট্যাঙ্কে জমে। সেখান থেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী সবাই পানি সংগ্রহ করা হয়। 

waterফগ ক্যাচারে লিমায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন 

লিমার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানির নাগাল পেত না। শহরের বাইরে থেকে স্বল্প পরিমাণ পানি আনা হতো ওয়াটার ট্রাকে করে। ওসব পানিতে উচ্চ পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড বা অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান থাকত। তার ওপর বেশ ব্যয়বহুল ছিল পানি সংগ্রহ। দরিদ্রদের পক্ষে এই পানি কেনা সম্ভব হতো না। ফলে লিমার প্রতি ৫ জনের একজন ব্যক্তিই পানির সংকটে ভুগতেন। এমন পরিস্থিতিতে ফগ ক্যাচার তাদের জন্য আশার আলো হয়ে আসে। তৃষ্ণায় মন ভরে গলা ভেজাতে পারছেন তারা। মরুর পাহাড়ি এলাকায় কমলা, আঙুর, জলপাই, অ্যাভোকেডো থেকে শুরু করে ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষ হচ্ছে। লেটুসের মতো সবজি চাষেরও স্বপ্ন দেখছেন তারা। 

পেরুর বিভিন্ন শহরে বর্তমানে ২ হাজারেরও বেশি ফগ ক্যাচার রয়েছে। প্রতিটি নেট দৈনিক ২০০-৪০০ লিটার বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে পারে। যা ব্যবহৃত হয় পান করা থেকে শুরু করে চাষাবাদের জন্য। 

waterঅর্থনীতিকে বদলে দেওয়া ফগ ক্যাচার

প্রযুক্তির যেকোনো উদ্ভাবন সাড়া ফেলে সমাজে। পেরুবাসীর ক্ষেত্রে ফগ ক্যাচার নিয়ে এসেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন। পুরুষরা ফগ ক্যাচার তৈরি ও স্থাপনের কাজ করেন। নারীরা পানি সংগ্রহ ও বণ্টনের কাজ করেন। আগে যেই পানি সংগ্রহে তাদের ৩/৪ ঘণ্টা সময় লাগত এখন তা করতে পারছেন স্বল্প সময়ে। বাড়তি সময় কাজে লাগাচ্ছেন চাষের কাজে কিংবা সন্তান লালন-পালনে। পানির জন্য চাষ বেড়েছে। চাষাবাদ ও খামার বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশ। 

ক্রুসের সাফল্য

প্রথম দিকে ক্রুসের কথাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কুয়াশা থেকে পানি পাওয়ার বিষয়টি তাদের কাছে গাঁজাখুরি গল্প মনে হয়েছিল। ক্রুস তাদের বোঝান, গাছপালা কেবল বাতাসেই বড় হচ্ছে না। তাদের পানিও লাগছে। আর এই পানি তারা কুয়াশা থেকেই পাচ্ছে। তিনি প্রমাণ করে দেখান নিজের ভাবনাকে। এরপর একসময় সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে তাকে। পরিচিত হয় ফগ ক্যাচারের সঙ্গে। 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইউরোনিউজ ডট কম, উইকিপিডিয়া।

এনএম/এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর