সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সিদ্দিকুর রহমান: বলবয় থেকে সফল গলফার

ফুয়াদ হাসান
প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:২৮ এএম

শেয়ার করুন:

সিদ্দিকুর রহমান: বলবয় থেকে সফল গলফার

শুধু যে দুইটি এশিয়ান ট্যুর, ছয়টি পেশাদার টুর্নামেন্ট, বারোটি অপেশাদার টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন তা নয়। দেশের একমাত্র গলফার হিসেবে খেলেছেন বিশ্বকাপে, ওয়াইল্ড কার্ড ছাড়াই সরাসরি নিজেকে নিয়ে গেছেন অলিম্পিকের মঞ্চে। দীর্ঘদিন ছিলেন এশিয়ার সেরা দশজন গলফারের মধ্যেও একজন।

গলফ কোর্সে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নামকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যার জন্য বিশ্ব এখন এই দেশটাকে গলফের জন্য হলেও চেনে। বলছিলাম বাংলাদেশের সফল গলফার সিদ্দিকুর রহমানের কথা। বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে অভিজাত খেলা গলফ খেলে যিনি হয়েছেন সেরাদের সেরা।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন- ফুটবলে বাংলার মেয়েদের ‘বিপ্লব’

বাংলাদেশে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও কাবাডির বাইরে অন্য খেলাগুলো বেশ অপ্রচলিত ও অবহেলিত। যার দরুন পৃথিবীর অন্যতম অভিজাত খেলা গলফ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ অনেকটাই কম। এমনকি এই খেলাটি বোঝেন, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াও বেশ দুষ্কর। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এই গলফ খেলেই গোটা দুনিয়ার সামনে বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন দেশসেরা গলফার সিদ্দিকুর রহমান। যার তারকা হওয়ার পেছনে রয়েছে হার না মানা সংগ্রামের গল্প।

আফজাল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের চার সন্তানের মধ্যে সিদ্দিকুরের অবস্থান তৃতীয়। স্বাধীনতার পরপর বাবা আফজাল হোসেন পুরো পরিবার নিয়ে পেটের দায়ে মাদারীপুর থেকে চলে আসেন ঢাকার ধামালকোট বস্তিতে। সন্ত্রাস ও মাদকের আঁতুড়ঘর খ্যাত সেই বস্তিতে বেড়ে ওঠা সিদ্দিকুরকে নিয়ে বাবা আফজাল হোসেন সবসময় থাকতেন নানা চিন্তায়। এরই মাঝে আফজাল হোসেন একদিন শুনতে পান, ছেলে সিদ্দিকুর বস্তি থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে বল কুড়োনোর কাজ করে। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাবা খবরটি শুনতে পেয়ে স্বস্তি পান।


বিজ্ঞাপন


এরপর থেকেই দৈনিক ত্রিশ টাকা মজুরিতে গলফ কোর্সে বল কুড়ানো সিদ্দিকুর খেয়ে না খেয়ে দৌড়াতেন গলফের মাঠে। এভাবেই একদিন ‘বলবয়’ থেকে পদোন্নতি পেয়ে ‘ক্যাডি’ হয়ে যান তিনি। ধীরে ধীরে মনের মধ্যে গলফ খেলার বাসনা জাগে সিদ্দিকুরের। তবে ব্যয়বহুল খেলা গলফের সরঞ্জামগুলোর দাম অনেক বেশি হওয়ায় একটি বুদ্ধি বের করেন তিনি। রড দিয়ে কামারের কাছ থেকে একটা গলফ ক্লাব বানিয়ে নেন সিদ্দিকুর। এরপর থেকেই শুরু হয় ক্যাডিবয়ের কাজের পাশাপাশি নিজের গলফ চর্চা।

আরও পড়ুন- বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে যেদিন ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ

বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশনের কর্মকর্তারা ২০০০ সালের দিকে একটি বিশেষ পদক্ষেপ হাতে নেন। দেশের প্রতিযোগিতামূলক গলফে বলবয়-ক্যাডি হয়ে আসা সুবিধাবঞ্চিত গলফারদের খেলার সুযোগ তৈরি করে দেন তারা। আর সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে ফেলেন সিদ্দিকুর। কোচের অধীনে শুরু করেন অনুশীলন। অন্য সবার থেকে প্রবল আগ্রহ ও ধৈর্য বেশি থাকায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে আসতে থাকেন নজরে। জিততে শুরু করেন একের পর এক অপেশাদার গলফ টুর্নামেন্টের শিরোপা।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের দিকে সিদ্দিকুর রহমান প্রবেশ করেন গলফের পেশাদার জগতে। বেশ কয়েকটা টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। এর মধ্যেই ২০০৮ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত প্রফেশনাল গলফ ট্যুর অব ইন্ডিয়ায় প্রফেশনাল প্লেয়ার্স চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম বাংলাদেশি গলফার হিসেবে জিতে নেন আসর সেরার পুরস্কার। এর পর ভারতের মাটিতে আরও দুইটি জয়সহ অন্যান্য আসরে অংশ নিয়ে পেশাদার গলফে নিজের পরিচিতিকে করেন আরও সমৃদ্ধশীল।

পরের দিনগুলোতে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সিদ্দিকুরের। এশিয়ান র‍্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে থাকার সুবাদে ২০১৩ গলফ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ধারাবাহিক সাফল্যে একটা সময় এশিয়ান র‍্যাঙ্কিংয়ের নয় নাম্বারে উঠে আসেন সিদ্দিকুর। জিতেন এশিয়ান ট্যুরের অন্যতম জনপ্রিয় ও বড় টুর্নামেন্ট হিরো ইন্ডিয়ান ওপেনের শিরোপা।

২০১৬ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত রিও অলিম্পিকে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সিদ্দিকুর রহমান সরাসরি খেলার সুযোগ পান। বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে পেশাদার গলফারের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি। তার মধ্যে মাত্র ৬০ জন সুযোগ পান অলিম্পিকে যোগ দেওয়ার। এই ৬০ জনের মধ্যে প্রায় ৩০ জন শুধু আমেরিকা থেকেই খেলে থাকেন। বাকি ৩০ জনের মধ্যে একজন গলফার হিসেবে ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান সিদ্দিকুর। সেই সঙ্গে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান এই দেশসেরা গলফার।

আরও পড়ুন- এমবাপে নয় গোল্ডেন বুটের ‘মালিক’ হতো মেসি, বেরিয়ে এলো আসল রহস্য

সিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রী অরণীও একজন অ্যামেচার গলফার। এই গলফার দম্পতির বিয়ে হয় ২০১৫ সালের ২০শে জানুয়ারি। অরণী জাতীয় অ্যামেচার ওপেনে তিনবার রানার্সআপ। তাছাড়াও বাংলাদেশ গেমসে সেনাবাহিনীর হয়ে ব্রোঞ্জ ও দলগতভাবে সোনা জিতেছেন তিনি। বর্তমানে কোচিংয়ে সংশ্লিষ্ট অরণী সিদ্দিকুরের সঙ্গে ব্যাকআপ হিসেবে বিভিন্ন ট্যুরে পার্টনার হিসেবে থাকেন।

দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সিদ্দিকুর গলফ খেলে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বর্তমান সময়ে তাকে দেখে অনেকেই ব্যয়বহুল খেলা গলফের দিকে ঝুঁকছেন। তবে যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় অনেকেই ঝরে পড়ছেন শুরুতেই। তাই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও সিদ্দিকুরকে পাবে বাংলাদেশ। যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দেশকে তুলে ধরবে বিশ্বমঞ্চের সম্মানজনক স্থানে।

এফএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর