বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হারিয়ে যাওয়া গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা-১

শেখ ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশিত: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৫:৫২ পিএম

শেয়ার করুন:

হারিয়ে যাওয়া গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা-১
আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক খেলা | (ছবি:সংগৃহীত)

আধুনিকতার ছোঁয়া যে শুধু নাগরিক জীবনে লেগেছে সেটা নয়, বাংলাদেশের গ্রামের দিকে তাকালে গত এক দশকে বা তার খানিকটা বেশি সময়ে আধুনিকতার স্পর্শ আর সভ্যতার ক্রমবিকাশে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তা স্পষ্ট ফুটে উঠে। আর এ পরিবর্তনের ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাও। 

যাদের জন্ম গত শতাব্দীর শেষভাগে বা নব্বইয়ের দশকে তারা এ পরিবর্তনকে নিজ চোখে দেখেছেন। নব্বইয়ের দশকে জন্ম নিয়ে গ্রামে বড় হওয়া প্রতিটি মানুষই ছোটবেলায় মেতে থাকতেন নানা ধরনের খেলাধুলায় । বিশেষ করে বিকেল হলেই গ্রামের প্রতিটি ছেলেমেয়েকে দেখা যেত ফাঁকা জায়গায় বা মাঠে জড়ো হয়ে নানা ধরনের খেলায় মেতে থাকতে।   


বিজ্ঞাপন


শৈশব মানেই ছিল দুরন্তপনা আর নানা ধরনের খেলাধুলায় মেতে থাকা। এসব খেলাধুলার ছিল গ্রামীণ নিজস্ব রীতিনীতি । তাই স্বভাবতই এসব আমাদের আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে ধারণ করত । 

কিন্তু এখন এসব দৃশ্য দেখতে পাওয়াই বিরল। গ্রামীণ জনপদে নাগরিক জীবনের ছাপ পড়ায় আজ মূর্ছা গেছে এসব দৃশ্য। এখন বাংলাদেশের গ্রামের মাঠঘাঠ ফাঁকা থাকে, শুধু খেলা নয় আধুনিককালে অনেকেই ভুলে যেতে বসেছেন এসব খেলার নামও।

তবে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে হলেও গ্রাম বাংলার কয়েকটি খেলা এখনও টিকে আছে। যেমন- নৌকা বাইচ, গোল্লাছুট, বৌচি, কানামাছি, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি। 

এছাড়াও হরেকরকম খেলা ছিল গ্রামবাংলায় যার কতগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর বাকিগুলোও বিলুপ্ত প্রায়। ডাংগুলি, লাঠি খেলা, চারগুটি, চেয়ার সিটিং, মার্বেল, বরফ পানি, ওপেন টি বায়োস্কোপ, সাত পাতা, এক্কা দোক্কা, কুতকুত, মোরগ লড়াই, ষাড়ের লড়াই, লাটিম, লুডু, ষোল গুটি, রুমাল চুড়ি, কড়ি খেলাসহ আরও নানা ধরনের গ্রামীণ খেলা রয়েছে যেসবের নাম আজ মানুষ ভুলতে বসেছে ।

শারীরিক কসরত আছে বলে এসব খেলাধুলার বেশিরভাগই একদিকে যেমন ছিল বিনোদনের মাধ্যম, পাশাপাশি স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।

 ছবি:সংগৃহীত

ডাঙ্গুলি

বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে গ্রামে জন্ম নিয়েছেন অথচ ডাঙ্গুলি  খেলাটির সাথে তাদের পরিচয় ঘটেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ডাঙ্গুলি  একটি প্রাচীন খেলা। অতীতে বাংলাদেশ, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ পৃথিবীর নানা দেশে জনপ্রিয় খেলা ছিল ডাঙ্গুলি । ইতিহাস বলে প্রায় ২৫০০ বছর আগে মৌর্য আমল এই খেলার সূচনা হয়।    

ডাঙ্গুলি  খেলায় খুব বেশি উপকরণ প্রয়োজন হয় না। এ খেলার উপকরণ দু'টি। একটি হল দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা লাঠি যা গ্রামের ভাষায় ডান্ডা নামে পরিচিত আর অপরটি প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা লাঠির টুকরোর মতো যা গুলি নামে পরিচিত । গুলির দুই প্রান্ত কিছুটা সুচালো থাকে ।

সাধারণত প্রতি দলে দুই থেকে পাঁচ-ছয়জন করে দুই দলে বিভক্ত হয়ে খেলা হয় ডাঙ্গুলি  । তবে এলাকাভেদে নানা নিয়মও দেখা মিলে এ খেলায়।

খেলার নিয়মটি এমন- প্রথমে খোলা মাঠে একটি ছোট গর্ত করা হয়। টসের মাধ্যমে যে দল দান পায় বা টসে জিতে তাদের একজন গর্তের ওপর গুলি রেখে ডান্ডা মেরে সেটিকে দূরে ফেলার চেষ্টা করে। তখন গুলিকে সে ডান্ডা দিয়ে দূরে সরাতে পারলে আবার সুযোগ পায় গুলিকে ডান্ডা মেরে শূন্যে তোলার। গুলি শূন্যে থাকা অবস্থায় সেটিকে পরের বাড়িতে দূরে ফেলার চেষ্টা করে ওই খেলোয়াড়। একই সাথে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকে গুলিকে ধরার জন্য।  

শূন্যে থাকা অবস্থায় গুলি ধরতে পারলে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা সফল হয় আর ওই খেলোয়াড় আউট হয়। কিন্তু ধরতে না পারলে খেলোয়াড়টি তার ডান্ডা গর্তের ওপর রাখে এবং প্রতিপক্ষের যে কোন একজন খেলোয়াড় গর্তের ওপর রাখা ডান্ডা লক্ষ করে গুলিটি ছুড়ে মারে। 

এক্ষেত্রে গুলিটি ডান্ডা ছুঁলে খেলোয়াড়টি দান হারায়, আর না ছুঁলে সে আবার গুলিটি ডাণ্ডা দিয়ে দূরে পাঠায়। পরে গুলি থেকে গর্ত পর্যন্ত ডান্ডা দিয়ে মাপতে হয়। 

সাত পর্যন্ত মাপের আঞ্চলিক নামও রয়েছে- বাড়ি, দুড়ি, তেড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক বা ঘোড়া, দুরি, তিনি, চারি,পাচি, ছয়, ভয় ইত্যাদি। এভাবে সাত মাপে হয় এক ফুল বা গুট, আর সাত ফুলে হয় এক লাল। আউট না হওয়া পর্যন্ত একজন খেলোয়াড় খেলতে পারেন। আউট হলে দ্বিতীয় একজন একই পদ্ধতিতে খেলবে। এভাবে সবাই আউট হলে বিপক্ষ দল দান বা সুযোগ পেয়ে খেলা শুরু করে। এভাবে শেষ করার পর যে দলের পয়েন্ট বেশি, খেলায় সেই দল জয়ী হয়।

শোনা যায়, ভারতবর্ষে ডাংগুলি খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশরা ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিল। এর পেছনে যুক্তিও দেওয়া হয় যে ডাংগুলি খেলায় ক্রিকেটের মতো ক্যাচ হলে আউটের নিয়ম আছে। সেজন্য খেলাটিকে অনেকটা ক্রিকেটের সমতুল্য বলে ধরা হয়। 

ইংরেজীতে ডাংগুলি টিপক্যাট, অসমিয়ায় তাং গুটি বলে পরিচিত । আর বাংলায় ডাংগুলি (ডাঙ্গুলি) বলে বহুল প্রচলিত হলেও অঞ্চলভেদে খেলাটি ভিন্ন নামেও ডাকা হয়।  

ছোটবেলায় নিষিদ্ধ খেলার মধ্যে একটি ছিল মার্বেল খেলা | (ছবি:সংগৃহীত)

মার্বেল বা গুটি খেলা

কাঁচের বা প্লাস্টিকের তৈরি ছোট বলই হল মার্বেল। ছোটবেলায় নিষিদ্ধ খেলার মধ্যে একটি ছিল মার্বেল খেলা । মার্বেল খেলায় কমপক্ষে দুইজন থেকে প্রয়োজন তিন, চার, পাঁচ, বা সাতজন খেলোয়াড়। 

সাধারণত হাতের আঙুলের সাহায্যে একটি মার্বেল দিয়ে অপর একটি মার্বেলকে আঘাত করে খেলা হয় মার্বেল খেলা। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় আরো নানা নিয়ম প্রচলিত আছে এ খেলায়।

আরেকটি নিয়ম হল সমতল জায়গায় কিছুটা দূরত্ব রেখে প্রথমে দুইটি দাগ টানা। প্রথম দাগের বাইরে একজন খেলোয়াড় তার পা রেখে অন্য দাগের বাইরে মার্বেল বা গুটি চালবে । 

বাকি খেলোয়াড়রা অথবা বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা যে গুটিগুলো চালা হবে সেগুলোর মধ্যে একটি গুটিকেই নির্দিষ্ট করে দিবে অন্য মার্বেল দিয়ে লাগানোর জন্য। 

দাগের প্রান্তের খেলোয়াড়টি তার হাতে থাকা যে কোন একটি মার্বেল দিয়ে অনেকগুলো গুটির মাঝে নির্দিষ্ট মার্বেলটিতে লাগাতে পারলেই সে যত সংখ্যক গুটি চালবে সেগুলো তাকে দিতে হবে এবং আবারও খেলার সুযোগ পাবে। তবে একের অধিক গুটিতে লাগলে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা খেলার সুযোগ পাবে। 

এছাড়া মার্বেল বা গুটি খেলার আরও অনেক নিয়মাবলি রয়েছে। 

লাটিম খেলাটি এখনও কিছুটা চোখে পড়ে গ্রামবাংলায় | (ছবি:সংগৃহীত)

লাটিম খেলা 

লাটিম খেলাটি এখনও কিছুটা চোখে পড়ে গ্রামবাংলায়। পেয়ারা ও গাবগাছের নরম কাঠ দিয়ে তৈরি হয় লাটিম । আর লাটিম ঘোরানোর জন্য যে সুতা ব্যবহৃত হয়, তাকে বলা হয় লতি। বেল্লা পার ও ঘর কোপ এই দুটি নিয়মে খেলা হয় লাটিম। 

প্রথমে সমতল ভূমিতে একটি বৃত্ত আঁকা হয়। একটি লাটিমের সঙ্গে লেপতির এক মাথা বাধা হয় এবং এরপর একজন লেপতির অপর মাথা মাটিতে এক স্থানে চেপে ধরে। এভাবে লাটিমটি মাটিতে ঘুরালেই আঁকা হয়ে যায় বৃত্ত। 

খেলোয়াড়রা তাদের লাটিমগুলো বৃত্তের মধ্যে ঘোরানো শুরু করে। এরপর যার লাটিমটি ঘুরতে ঘুরতে সবচেয়ে বেশিক্ষণ বৃত্তের মধ্যে থাকে সে হয় জয়ী। এক্ষেত্রে অন্য লাটিমগুলো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে যায়। আবার একজনের লাটিম বৃত্তের মধ্যে ঘুরে ঘুরে যদি অন্যের লাটিমকে আঘাত করতে পারে, তবে সে সেই লাটিমের মালিক হয়ে যায়।  

এছাড়া লাটিমের আঘাতে অন্যের লাটিম ভেঙে যায় অনেক সময়। সেইসাথে হাতের তালুতেও লাটিম ঘোরাতে দেখা যায়। 

 

ছবি:সংগৃহীত

লাঠি খেলা

প্রচীনকালে বড়লোক বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা মিলত লাঠি খেলার। এই খেলার জন্য ব্যবহৃত লাঠি লম্বায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট এবং তৈলাক্ত হয়। খেলোয়াড়রা কখনও এককভাবে, কখনও দ্বৈতভাবে এ খেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। 'লাঠি খেলা' অনুশীলনকারীকে বলা হয়  'লাঠিয়াল'। লাঠিয়ালরা সামনে, পেছনে, পাশে, মাথার ওপরে, দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে নানা কৌশলে লাঠি ঘুরিয়ে খেলা দেখায় । সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নড়াইল ইত্যাদি জেলায় ঈদ উপলক্ষে লাঠিখেলার আয়োজন করতে দেখা যায়।

 
এসও 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর