বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সোহাগী ও স্বপ্নার জন্য গর্বিত ঠাকুরগাঁওবাসী

জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫২ পিএম

শেয়ার করুন:

সোহাগী ও স্বপ্নার জন্য গর্বিত ঠাকুরগাঁওবাসী

নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব নারী দলের এবারই প্রথম। এর আগে ২০১৬ সালে ভারতের শিলিগুড়িতে ভারতের বিপক্ষে খেলে হেরেছিল বাংলাদেশ। এবার নেপালের কাঠমুন্ডুতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এতে ঠাকুরগাঁওবাসী সহ পুরো দেশবাসী গর্বিত ও আনন্দিত। 

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী জাতীয় নারী ফুটবল দলের দুই সদস্য ঠাকুরগাঁওয়ের সোহাগী কিসকু ও স্বপ্না রানী। গত সোমবার কাঠমান্ডুতে নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর আনন্দিত ও গর্বিত হয়ে গ্রামবাসীরা সোহাগী-স্বপ্নার পরিবারকে অভিনন্দন জানিয়ে মিষ্টিমুখ করান।


বিজ্ঞাপন


তাদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় পুরো জেলাজুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে। খেলা শেষ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। সেই স্বপ্না আর সোহাগীকে নিয়ে গর্বিত ঠাকুরগাঁও জেলা মানুষ।

এই তো সেদিনের কথা। যে গ্রামবাসী সবসময় বলত মেয়েরা ফুটবল খেলবে, এ নিয়ে কত কথা, কত কটূক্তি ! সেসব উপেক্ষা করে খেলা চালিয়ে গেছেন সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানী। এখন তারা বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের গর্বিত মুখ।

নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের দুই খেলোয়াড় সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানীর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায়। ঠাকুরগাঁও শহরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম তিনি বলেন, 'ছেলে খেলোয়াড়রা এতো দিন যা পারেন নেই তা করিয়ে দেখিয়েছেন নারী ফুটবলাররা। এতে শুধু ঠাকুরগাঁও নয় পুরো দেশবাসী নারী ফুটবলারদের জন্য আনন্দিত এবং গর্বিত। আশা করি ভবিষ্যতে তারা আরো দেশের জন্য ভালো কিছু করবে।,


বিজ্ঞাপন


ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সোহাগী কিসকু। বাবা গুলজার কিসকু পেশায় কৃষিশ্রমিক। সোহাগীরা তিন বোন, দুই ভাই। বড় বোন ইপিনা কিসকুর বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি চার ভাইবোনই ফুটবল খেলে। ছোট বোন কোহাতি কিসকু অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় নারী দলের খেলোয়াড়।

জাতীয় নারী দলের সদস্য সোহাগীর ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে গুলজার কিসকু ঢাকা মেইলকে বলেন, ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি সোহাগীর টান ছিল। প্রাইমারি স্কুলে থাকা অবস্থায় বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট দিয়ে ফুটবল খেলা শুরু তার। এরপর যখন রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন, তখন সোহাগী সেখানে যোগ দেন। এতে ‘মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে খেলে’, ‘লজ্জা-শরম নেই’, ‘এদের কখনো বিয়ে হবে না’ এমন সব কটূক্তি মূলক নানা কথা বলতেন গ্রামের লোকজন। লোকজনের এমন কথা রেগে গিয়ে মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতাম। তবে যখনই সুযোগ পেতেন, মাঠে চলে যেতেন সোহাগী।,

নিয়মিত অনুশীলন করে অনূর্ধ্ব-১৪ ঠাকুরগাঁও জেলা দলে জায়গা করে নেন সোহাগী। ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা ফুটবল দল বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। সেবার সোহাগী অসাধারণ পারফর্ম করেন। সে সময় সোহাগী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) এক কর্মকর্তার নজরে পড়েন। ওই কর্মকর্তা নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে সোহাগীর ব্যাপারে জানান। তিনি তাজুল ইসলামকে ফোন করে সোহাগীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে বলেন। এরপর সোহাগী অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব–১৮ পেরিয়ে এখন জাতীয় দলে।

সোহাগীর বাবা আরও বলেন, মেয়ের খেলা হলে পরিবারের সবাই মিলে দেখেন। গত সোমবারেও বাংলাদেশ ও নেপালের ফাইনাল খেলাটিও দেখেছি।

সোহাগী কিসকুর বোন ইপিনা কিসকো বলেন, বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল ফাইনালে জয়ী হয়েছে। এই দলে আমার বোনও রয়েছে। আমরা সবাই খুশি আর সেই সাথে ঠাকুরগাঁও জেলাবাসী তাদের জন্য আজ গর্ববোধ করছে।

রানীশংকৈল উপজেলার বনগাঁও শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে স্বপ্নাদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্বপ্নার মা সাবিলা রানী তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত। স্বপ্নার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ফুটবল খেলতে গিয়ে মেয়েটা কতই না কষ্ট করেছে। তবে তার কষ্ট হলে ময়েটার জন্য আজ আমাকে খুবই ভালো লাগছে ও আমি খুবই আনন্দিত।’

স্বপ্নার বাবা নীরেন হৃদরোগে ভুগছেন। খুব একটা কাজ করতে পারেন না। স্বপ্নার বড় বোন কৃষ্ণা রানীর সেলাইয়ের আয়ে সংসার চলে। আরেক ভাই ও বোন লেখাপড়া করছে। স্বপ্নার বাবা জানান, স্বপ্না ২০১৬ সালের দিকে স্থানীয় নারী ফুটবল দলে সুযোগ পায়। সেখান থেকে ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। সেখান থেকে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলার পর ২০১৯ সালে জাতীয় নারী ফুটবল দলে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলা শুরু করে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাড়ি রানীশংকৈল শুনলে অনেকেই বলেন, ফুটবল খেলে স্বপ্নাকে চেনেন? তাদের যখন বলি, আমিই স্বপ্নার বাবা, তখন তারা আমাকে খুব সম্মান করেন। মেয়ের জন্য গর্বে বুকটা ভরে যায়। তবে মেয়ে ফাইনালে খেলার সুযোগ পেলে আরও ভালো লাগত।’

স্বপ্নার বাবা সাথে কথা বলতে বলতে স্বপ্নার মা বলে উঠেন, যে মেয়ে খেলেনি, তাতে কী হয়েছে? আমরা তো জিতেছি! যে মেয়েরা আমাদের জন্য এত সম্মান এনে দিল, সেই দলে আমার মেয়েও আছে, এটা ভাবতেই বুকটা ভরে যায়।’

রাণীশংকৈল রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, 'ফুটবলের প্রতি সোহাগী আর স্বপ্নার প্রবল আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই একের পর এক সীমানা পেরিয়ে গেছে তারা। তাদের দেখে আরও কিশোরী ফুটবল খেলায় মনোযোগী হচ্ছে। একাডেমির কাকলি আকতার ও ঈশিতা পর্তুগালে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। কবিতা, প্রতিকা, অনিকা, মৈত্রীসহ কয়েকজন জাতীয় পর্যায়ে খেলার স্বপ্ন দেখছে। তাদের অনুপ্রেরণা এখন সোহাগী আর স্বপ্না।,

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন জানিয়ে রাণীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, 'এ উপজেলার দুজন নারী খেলোয়ার জাতীয় দলের হয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করায় তাদের জন্য আমরা গর্বিত। সোহাগী কিসকু ও স্বপ্না রানী আগামী ৫ অক্টোবর ছুটিতে আসলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

এছাড়া স্বপ্না ও সোহাগীকে অভিনন্দন জানিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী জাতীয় নারী ফুটবল দলে আমাদের রাণীশংকৈলের দুজন খেলোয়াড় প্রতিনিধিত্ব করেছে। এতে আমরা গর্বিত। আমরা আশা করছি যেভাবে আমাদের নারী ফুটবলাররা এগিয়ে যাচ্ছে তাতা সামনের দিনে কিশোরীদের ফুটবল খেলায় আরও অংশগ্রহণ  বাড়বে।

প্রতিনিধি/এমএএম 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর