২০২৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ভারতের দল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ক্রিকেট মহলে নেমে এসেছে তীব্র আলোড়ন। তবে আলোচনার কেন্দ্রে কোনো বিদায়ী তারকা বা চোটাক্রান্ত ক্রিকেটার নন, বরং ভারতের ভবিষ্যৎ মুখ বলে এতদিন যাকে ধরা হতো, সেই শুবমান গিল। ‘প্রিন্স অব ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’-এর এমন বাদ পড়া অনেকের চোখে চরম সিদ্ধান্ত মনে হলেও, বাস্তবে এটি ভারতের নতুন প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীরের সবচেয়ে স্পষ্ট বার্তা- ভারতীয় দলে আর “সুপারস্টার সংস্কৃতি” চলবে না।
ভারতীয় ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরেই একটি অভিযোগ ছিল, কিছু ক্রিকেটার এমন এক অবস্থানে পৌঁছে যান, যাদের বাদ দেওয়া যায় না, ফর্ম বা কৌশলগত প্রয়োজন যাই হোক না কেন। গম্ভীরের এই সিদ্ধান্ত কার্যত সেই যুগের ইতি টানল। কারণ, শুবমান গিল এমন একজন ক্রিকেটার, যিনি বর্তমানে টেস্ট ও ওয়ানডে দলে অধিনায়কত্ব করছেন এবং টি-টোয়েন্টিতে ছিলেন সহ-অধিনায়ক। এমন একজনকে বাদ দেওয়ার মানে স্পষ্ট, নামের চেয়ে পারফরম্যান্স বড়।
বিজ্ঞাপন
গিলের বদলে অভিষেক শর্মা কিংবা দীর্ঘ বিরতির পর ফেরা ইশান কিশানকে বেছে নেওয়া শুধুই দল নির্বাচনের বিষয় নয়, এটি একটি দর্শনগত অবস্থান। গম্ভীর বোঝাতে চেয়েছেন, ব্র্যান্ড নয়, ফলাফলই শেষ কথা। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ড্রেসিংরুমেও পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে- কেউ দলের ঊর্ধ্বে নয়। যদি কারও স্ট্রাইক রেট, ভূমিকা বা ম্যাচ পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দলের চাহিদার সঙ্গে না মেলে, তাহলে অতীত সাফল্য বা জনপ্রিয়তা তাকে বাঁচাতে পারবে না।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ‘অ্যাঙ্কর’ ব্যাটারের ভূমিকা নিয়ে গম্ভীর বরাবরই সমালোচনামুখর। আধুনিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম বল থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিংই মূল চাহিদা। চাপের মুহূর্তে গিলের স্ট্রাইক রেট নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছে। ওপেনিংয়ে জায়গা দিতে গিয়ে এক সময় সঞ্জু স্যামসনকে বাইরে বসাতে হয়েছিল, কারণ গিলের একমাত্র কার্যকর জায়গা ছিল ইনিংসের শুরুতে। কিন্তু পাওয়ারপ্লেতে দ্রুত রান তোলার ক্রিকেটার হিসেবে তিনি যে পুরোপুরি মানানসই নন, সেটি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল।
গম্ভীরের পছন্দ ‘টেকনিক্যালি নিখুঁত’ নয়, বরং ‘ভয়ডরহীন’ ক্রিকেটার। এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন নয়। ২০২৬ বিশ্বকাপ দলে সঞ্জু স্যামসন ও রিঙ্কু সিংয়ের মতো ব্যাটারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া তারই প্রমাণ, যেখানে আগ্রাসন ও ইনটেন্ট প্রাধান্য পাচ্ছে, ক্লাসিক্যাল ব্যাটিং নয়। এখানে আরেকটি বড় দিক হলো জবাবদিহি। সাম্প্রতিক সময়ে টি-টোয়েন্টিতে গিলের ফর্ম, বিশেষ করে মন্থর উইকেটে তার মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আগের ব্যবস্থায় হয়তো তাকে ‘সম্ভাবনা’র দোহাই দিয়ে দলে রাখা হতো। গম্ভীরের যুগে সেই জায়গা নেই। এখানে বিচার হবে কেবল পারফরম্যান্সে।
গম্ভীরের দর্শন খুব সরল- তিনজন সুপারস্টার আর আটজন দর্শকের চেয়ে, এগারোজন পরিশ্রমী ক্রিকেটারের দল অনেক বেশি কার্যকর। ‘প্রিন্স’-কে বাদ দিয়ে তিনি এমন একটি দল গড়ার পথ খুলেছেন, যারা জার্সির সামনে থাকা প্রতীকের জন্য খেলবে, পেছনের নামের জন্য নয়। তবে ঝুঁকি যে নেই, তা নয়। গিলকে বাদ দেওয়ায় দল হারাল অভিজ্ঞতা, আর অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবও পেলেন না সেই সহ-অধিনায়ককে, যাকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করা হচ্ছিল।
বিজ্ঞাপন
ভারত যদি এই দল নিয়ে বিশ্বকাপ জিতে যায়, তাহলে এটি ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যদি ব্যর্থ হয় তাহলে গম্ভীর ও নির্বাচকদের এই সিদ্ধান্ত যে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

