অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটটা ছিল ঠান্ডা মাথার- একবার লাগাম টানলে আর ছাড়ার নাম নেই। তৃতীয় টেস্টে ৪৩৫ রানের বিশাল লক্ষ্য ছুড়ে দিয়ে তারা এমন এক বাস্তবতায় ঠেলে দেয় ইংল্যান্ডকে, যেখানে সাহস থাকলেও পথ ছিল প্রায় বন্ধ। শেষ পর্যন্ত ব্যাট হাতে কিছুটা প্রতিরোধ গড়েছিলেন জ্যাক ক্রলি, কিন্তু প্যাট কামিন্স ও নাথান লায়নের চিরচেনা নিখুঁত বোলিংয়ে সেই আশাটুকুও গুঁড়িয়ে যায়। আরও দুই বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়া নিজেদের ঘরেই অ্যাশেজ শিরোপা রেখে দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
চতুর্থ ইনিংসে কামিন্স শুরুতেই ম্যাচের লাগাম টেনে ধরেন। প্রথম তিন উইকেটই তাঁর, যার মধ্যে জো রুটও আছেন, যাকে টেস্টে ১৩তমবারের মতো ফেরালেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক। দিনের শেষ ভাগে নাথান লায়ন দেখান নিজের জাদু, তিনটি উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের মনোবল ভেঙে দেন তিনি। ক্রলি লড়াই চালিয়ে গেলেও দ্বিতীয় শতকটি আর পাওয়া হয়নি। শেষ বিকেলে লায়নের ফাঁদে পা দিয়ে ক্রিজ ছাড়তেই অ্যালেক্স ক্যারির ক্ষিপ্র স্টাম্পিংয়ে ফেরেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
শেষ পর্যন্ত জেমি স্মিথ ও উইল জ্যাকস দিনের শেষ পর্যন্ত টিকে গেলেও বাস্তবতা নির্মম, লক্ষ্য থেকে এখনও ২০০ রানের বেশি দূরে ইংল্যান্ড, হাতে মাত্র চার উইকেট। রবিবার শেষদিনে টেইল এন্ডার ব্যাটারদের অলৌকিক কিছু না হলে, মাত্র ১১ দিনের ক্রিকেটেই অ্যাশেজ হারাতে যাচ্ছে ইংলিশরা।
এই ম্যাচে দাপুটে ১৭০ রানের ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন ট্রাভিস হেড। তবে চতুর্থ দিনের সকালে ইংল্যান্ড বোলিংয়ে শৃঙ্খলা দেখায়। মাত্র দেড় ঘণ্টার একটু বেশি সময়ে ছয় উইকেট তুলে নিয়ে বিশাল লক্ষ্যকে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠা থেকে অন্তত কিছুটা ঠেকায় তারা।

‘বাজবল’ যুগে রান তাড়া করাকে ইংল্যান্ড প্রায় দর্শন বানিয়ে ফেলেছিল। পরিষ্কার লক্ষ্য, শেষ ইনিংস- এই দুইয়ে নাকি তাদের সেরা ক্রিকেট বেরিয়ে আসে। কিন্তু ২–০ তে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় অ্যাডিলেডে সেই তত্ত্বটা কাগজেই রয়ে গেল। পিচ ব্যাটিংয়ের পক্ষে থাকলেও কামিন্স লাঞ্চের আগে ও পরে দুই দফায় আঘাত করে বুঝিয়ে দেন, এই চেজ কাগজে যতটা সুন্দর, মাঠে ততটাই নির্মম।
বিজ্ঞাপন
বেন ডাকেটের দুঃস্বপ্নের সফর আরও এক ধাপ এগোয়- দ্বিতীয় বলেই স্লিপে ক্যাচ। অলিভার পোপকে কামিন্স ও স্টার্ক চাপে রাখলেও বিদায় নিতে হয় মার্নাস লাবুশেনের অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে যা হয়তো তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ছবিও হয়ে থাকতে পারে। দুপুরে কিছুটা স্থিরতা আসে ক্রলি ও রুটের ৭৮ রানের জুটিতে। কিন্তু চা-বিরতির পর প্রথম ওভারেই আবার কামিন্স। অফ স্টাম্পের আশপাশে নিখুঁত চাপ, রুটের ব্যাটে ফাঁক- আরেকবার হতাশ মুখে মাঠ ছাড়েন ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটার।
এই ইনিংসে ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার থেকে ‘বাজবল’ খুব একটা দেখা যায়নি। পার্থ ও ব্রিসবেনের ব্যর্থতা হয়তো তাদের সাবধান করে দিয়েছিল। ক্রলি প্রথম ২৮ বলে মাত্র ১ রান করেন, ততক্ষণে পড়ে গেছে দুই উইকেট। কিন্তু ধৈর্যের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। নিয়ন্ত্রিত ড্রাইভ, ভালো বিচারবুদ্ধিতে সিরিজে নিজের সেরা ইনিংস খেলেন। লায়নের বিপক্ষে সুইপ ও রিভার্স সুইপেও ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, যদিও শুরুতে লায়নের ছয় ওভারে ৩৫ রান যাওয়ায় কামিন্স বাধ্য হন ট্রাভিস হেডকে বোলিংয়ে আনতে।

ক্রলি ও হ্যারি ব্রুক আরেকটি পঞ্চাশ ছোঁয়া জুটি গড়েন। তবে ব্রুক ছিলেন অস্বস্তিতে, স্কট বোল্যান্ড কিপার এগিয়ে রেখে বল করায় তাঁকে আটকে দেন। একবার ভুল শটে বেঁচে যান, আরেকবার রান নিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থামতে হয়। শেষ পর্যন্ত লায়নের বিপক্ষে রিভার্স সুইপই তাঁর পতনের কারণ- গতি ও টার্নের মিশেলে করা ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে যান তিনি।
এরপর লায়ন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেন। টেস্টে দশমবারের মতো বেন স্টোকসকে ফেরান এক দুর্দান্ত অফব্রেকে। এরপর ক্রলিও ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে ঠেলে মারতে গিয়ে স্টাম্পিংয়ের শিকার। স্কোর তখন ১৯৪/৬। বৃষ্টি এলেও আর কিছু বদলানোর ছিল না- অস্ট্রেলিয়ায় ইংল্যান্ডের জয়হীন সিরিজ বাড়তে চলেছে ১৮ টেস্টে।
এর আগে শনিবার হেড ও ক্যারির অবিচ্ছিন্ন জুটিতে অস্ট্রেলিয়া খেলায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ফিরেছিল। মনে হচ্ছিল তারা আরও অনেকক্ষণ ব্যাট করে ইংল্যান্ডের শেষ আশা নিভিয়ে দেবে। কিন্তু হেড আউট হতেই ইনিংসের চিত্র পাল্টায়। হেড তখন ১৫০ পেরিয়েছেন, ক্যারির সঙ্গে আট ওভারে ৪০ রান যোগ করেছেন। ক্যারিয়ার-সেরা ১৭৫ ছোঁয়ার পথে ছিলেন হেড, কিন্তু জশ টাংকে ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ক্রলির হাতে ধরা পড়েন।
ক্যারি তখন অন্য ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে- টেস্টে জোড়া সেঞ্চুরি করা তৃতীয় উইকেটকিপার হওয়ার পথে। কিন্তু স্টোকসের শর্ট বলে গ্লাভস ছুঁয়ে লেগ স্লিপে ক্যাচ ওঠায় সেই স্বপ্ন থামে। এরপর টাংয়ের বলে এজ করে ফেরেন ইংলিস। নতুন বল হাতে ইংল্যান্ডের লেজে কামড় বসান ক্যার্স- পরপর বলে কামিন্স ও লায়ন আউট। আর্চার ইনিংস শেষ করেন। ৬ উইকেটে ৩৮ রানের এই ধস কিছুক্ষণের জন্য হলেও ইংল্যান্ডকে আশার আলো দেখিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অ্যাডিলেডে গল্পটা একটাই- ইংল্যান্ড চেষ্টা করেছে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ছাড়েনি। আর অ্যাশেজ? সেটা আগেই নিরাপদ জায়গায় তুলে রেখেছে স্বাগতিকরা।

