লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ফের বিতর্কে ডিউক বল। ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের সকালে মাত্র ১০.৩ ওভার টিকেছিল দ্বিতীয় নতুন বল, তারপরই তা রীতিমতো অকার্যকর হয়ে পড়ে। ভারতীয় শিবির তখনই অসন্তোষ প্রকাশ করে। পরে আবার বদলানো হয় বল, সেটিও মাত্র ৪৮ বলের ব্যবধানে।
এর আগে প্রথম বল দিয়েই ইংল্যান্ডের টেলএন্ডারদের বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন জসপ্রিত বুমরাহ। মাত্র ১৪টি ডেলিভারিতে তুলে নিয়েছিলেন তিনটি উইকেট। কিন্তু বল বদলের পর পুরো সেশনেই আর কোনও উইকেট নিতে পারেনি ভারত। তখন ব্যাট করছিলেন ইংল্যান্ডের ৭ ও ৯ নম্বর ব্যাটার।
বিজ্ঞাপন
ক্রিকভিজের পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম নতুন বলটি গড়পড়তা সুইং করছিল ১.৮৬৯ ডিগ্রি ও সিম মুভ করছিল ০.৫৭৯ ডিগ্রি। কিন্তু যে বলটি দিয়ে খেলা আবার শুরু হয়, সেটির গড় সুইং ছিল ০.৮৫৫ ডিগ্রি আর সিম মুভ ০.৫৯৪ ডিগ্রি। তবে পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি সমস্যা ছিল বলের নরম হয়ে যাওয়া আর সেটির বয়স নিয়ে। বুমরাহ নিজেও বলেন, তিনি নিষেধাজ্ঞার ভয় করছেন বলে সরাসরি কিছু বলেননি, তবে এটাও উল্লেখ করেন যে এর আগের দুই ইংল্যান্ড সফরে এমন কিছু দেখেননি।

এই ডিউকস বল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা করে আসা ইংল্যান্ডের সাবেক পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড সরাসরি বলেন, “বলটা দেখে মনে হচ্ছিল কমপক্ষে ১৮-২০ ওভারের পুরনো।” পরে টুইটেও নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “ক্রিকেট বল হওয়া উচিত একজন ভালো উইকেটকিপারের মতো যা কখনোই চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু এখন আমরা বল নিয়েই কথা বলছি কারণ এটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বল প্রায় প্রতি ইনিংসে বদলাতে হচ্ছে। এটা চলতে পারে না। পাঁচ বছর ধরে এমন হচ্ছে। ডিউকসের এটা নিয়ে কিছু একটা করা দরকার। একটা বল ৮০ ওভার চলা উচিত, ১০ নয়।”
প্রাক্তন অধিনায়ক নাসের হুসেন স্কাই স্পোর্টসে বলেন, “ডিউকস বল নিয়ে বড় সমস্যা রয়েছে। ম্যাচের আগে দুই অধিনায়কই বিষয়টি তুলেছিলেন। দ্বিতীয় দিনে এক সেশনে দু’বার বল বদল- এটাই প্রমাণ। গত কয়েক বছর ধরেই বল দ্রুত অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।” তবে হুসেন এটাও বলেন, খেলোয়াড়রাও যেন একটু বেশিই বল বদলে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন, তিনি বলেন, “একটু পুরনো বা নরম হলেই বল বদলে ফেলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ৮০ ওভার পর্যন্ত ‘পারফেক্ট বল’ চাইছে সবাই।”
বিজ্ঞাপন
নাসের আরও বলেন, “বুমরাহ যেভাবে বল করছিলেন, সেই বলটা নিয়েই খেলতে থাকা উচিত ছিল। হঠাৎ করে এমন একটা বক্স থেকে নতুন বল নেওয়া যার কিছুই জানা নেই, সেটা কেন? যখন কিছু একটা কাজ করছে, সেটা বদলানোটা অদ্ভুত।”

২০২০ সাল থেকেই ডিউকস বল নিয়মিতই আকার হারাচ্ছে, দ্রুত নরম হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের চার রাউন্ডে কুকাবুরা বল ব্যবহার করেছে, যা ডিউকসের সমস্যাকেই সামনে এনেছে। এই সিরিজে বারবার বল বদলের ঘটনা ঘটছে, প্রায় প্রতি ম্যাচেই ৪৩তম ওভারের মধ্যে নতুন বল আনা হচ্ছে। এমনকি ম্যাচের প্রথম সেশনেই বল নিয়ে অভিযোগ উঠছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই সিরিজে ৩১ থেকে ৮০ ওভারের মধ্যে প্রতি উইকেট পেতে রান লেগেছে ৮৬.০৯, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বল-বাই-বল রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি। সব টেস্ট সিরিজ মিলিয়ে এটি তৃতীয় সর্বোচ্চ, শুধু ২০০৮-০৯ সালে শ্রীলঙ্কার পাকিস্তান সফর এবং ২০০০-০১ সালে জিম্বাবুয়ের নিউজিল্যান্ড সফরের নিচে।
ডিউক বল কি তবে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে? খেলোয়াড়দের প্রশ্নের জবাব দিতে মুখ খুলেছেন ডিউক বলের নির্মাণকারী কোম্পানির মালিক। লর্ডস টেস্ট চলাকালীন বল নিয়ে একের পর এক অভিযোগের মাঝে মুখ খুলেছেন বল নির্মাতা সংস্থা ব্রিটিশ ক্রিকেট বল লিমিটেডের কর্ণধার দিলীপ জাজোদিয়া। পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, খেলোয়াড়রা যেমন ডিউক বলের সমস্যাগুলো তুলে ধরছেন, তেমনি তারাও বসে নেই, চেষ্টা করছেন বলের মান উন্নত করার।

জাজোদিয়া বলেন, "আমার কোম্পানির ইতিহাস ১৮শ শতক পর্যন্ত গড়ায়। আমরা বলের মান উন্নয়নে অবশ্যই প্রস্তুত, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক গরম আবহাওয়া আর আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের ভারী ব্যাট ব্যবহারের কথা মাথায় রেখেই ভাবছি।"
তিনি আরও বলেন, “বিশ্ব ক্রিকেটে মাত্র তিনটি স্বীকৃত বল প্রস্তুতকারক রয়েছে- ডিউকস, এসজি আর কুকাবুরা। যদি এটা সহজ কাজ হতো, তাহলে বিশ্বজুড়ে শত শত কোম্পানি বল তৈরি করত। খেলোয়াড়দের এটা বুঝতে হবে, আমরা চুপচাপ বসে নেই। যদি কোনো সমস্যা থাকে, আমরা সেটা পর্যালোচনা করি। কোথায় সমস্যা, চামড়ায়, না অন্য কোথাও তা খতিয়ে দেখা হয়। আমি তো আর পা তুলে বসে সিগার খাচ্ছি না!”
সরাসরি সমালোচনার জবাবে কিছুটা মজা করেই তিনি বলেন, “খেলোয়াড়রা আমার বলের সমালোচনা করতে পারে। আমি কি ওদের বাজে শট বা বাজে বলের (লং হপ) সমালোচনা করতে পারি? বুঝতেই পারছেন আমি কী বোঝাতে চাইছি। একটু বাস্তববাদী হতে হবে।”
এদিকে চলতি সিরিজে ডিউক বল প্রায় প্রতি ম্যাচেই আকার হারাচ্ছে, অস্বাভাবিকভাবে নরম হয়ে যাচ্ছে এবং নিয়মিত বদলাতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ভারত ও ইংল্যান্ড দুই দলের খেলোয়াড়রাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এমন অবস্থায় বল প্রস্তুতকারকের এমন জবাব নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বল নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকলেও জাজোদিয়ার বক্তব্য স্পষ্ট। তারা দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন না, বরং সমাধানের পথেই রয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, মাঠের পারফরম্যান্সে সেটার কতটা প্রতিফলন পড়ে।

