সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ক্যানসার আর অ্যালকোহল আসক্তি জয় করে ইন্টারের নায়ক আচেরবি

স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩১ মে ২০২৫, ০১:৩৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ক্যানসার আর অ্যালকোহল আসক্তি জয় করে ইন্টারের নায়ক আচেরবি

ফ্রানচেস্কো আচেরবির গল্পটা একদম রূপকথার মতো। দূর থেকে শুরু, নায়ক হিসেবে এক ‘মানবিক’ স্বভাবের প্রাণী যেটা তার ক্ষেত্রে এক সিংহ- যার আছে ত্রুটি-গুণ দুই-ই। আর প্রতিটি আসল রূপকথার মতো, এর শেষেও আছে এক শিক্ষামূলক বার্তা। এটা ত্যাগ, লড়াই আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির গল্প। এমন এক গল্প, যেখানে আচেরবি তার বাবার মৃত্যুর পর মদ আর বিষণ্ণতার সাথে যুদ্ধ করেছেন, দুইবার টেস্টিকুলার ক্যানসারকে হারিয়েছেন, আর অবিশ্বাস্যভাবে ৩৭ বছর বয়সে ইন্টার মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের নায়ক বনে গেছে।

সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৯৩তম মিনিটে তার করা সমতাসূচক গোলেই ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে, যেখানে শেষ পর্যন্ত ইন্টার ৭-৬ ব্যবধানে জেতে। ডান দিক থেকে আসা এক ক্রসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বল জালে পাঠিয়েছিলেন আচেরবি, বুফন উত্তরসূরি উয়েচেখ শেসনির পাশ কাটিয়ে। ম্যাচ শেষে ইন্টার কোচ সিমোন ইনজাগি হেসে বললেন, “ওর এই সিদ্ধান্তটা একদম নিজস্ব ছিল, আমি কিছু বলিনি!”


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন- বন্যা দুর্গতদের মুখে আর্জেন্টিনার স্কোয়াড ঘোষণা

আরও পড়ুন- যেসব অনিয়মের কারণে বিসিবির সভাপতি পদ হারালেন ফারুক

আচেরবির সতীর্থ কার্লোস আগুস্তো বলেন, “ও যে শেষ মুহূর্তে বক্সে ঢোকার শক্তি খুঁজে পেয়েছে, তার জন্য আমি ওকে ধন্যবাদ জানাই। মাঠের বাইরে ওর গল্পটাও অনন্য। আচে (আচেরবির ডাকনাম) কখনো হার মানে না।”

4636


বিজ্ঞাপন


সেই রাতে আচেরবি তার ইউরোপীয় ক্লাব ক্যারিয়ারের ৬৫ ম্যাচে প্রথম গোল পেলেন। ম্যাচজুড়ে বল ছুঁয়েছিলেন ৪৬ বার, যার মধ্যে প্রতিপক্ষের বক্সে একটিই! তাও তার দুর্বল ডান পায়ে। সেন্টার-ব্যাক স্তেফান দে ফ্রেই বললেন, “সে একজন ডিফেন্ডার, কিন্তু গোলটা করল যেন একেবারে স্ট্রাইকারের মতো! এর মধ্যে এক ধরনের জাদু আছে, রূপকথার মতো।”

মিলান থেকে মাত্র ১৫ মাইল দূরের গ্রাম ভিজোলো প্রেদাবিসিতে জন্ম আচেরবির। এখানেই গড়ে উঠেছিল তার খেলার শুরুর স্বপ্ন। ২০০৬ সালে স্থানীয় ক্লাব পাভিয়ায় (সিরি সি) তার যাত্রা শুরু। এরপর রেনাতে (সিরি ডি) লোন পিরিয়ড, তারপর রেজিনা, জেনোয়া, কিয়েভো- যেখানে তিনি সিরি আ-তে অভিষেক করেন এবং প্রতিশ্রুতিশীল ডিফেন্ডার হিসেবে নজর কেড়ে নেন।

শৈশবের প্রিয় ক্লাব এসি মিলান ২০১২ সালে তাকে দলে নেয়, কিন্তু সেখানেই বাধে বিপত্তি। আচেরবির সমস্যার শেকড় ছিল তার বাবার সাথে জটিল সম্পর্ক। বাবা ছিলেন তার প্রথম ভক্ত, কিন্তু একসাথে সবচেয়ে কঠোর সমালোচকও। আচেরবি বলেছিলেন, “উনি আমাকে ভালো রাখতে চাইতেন, কিন্তু কখনো কখনো সেটা করতে গিয়ে আমাকে আঘাত দিতেন।”

GettyImages-2213789417.jpg

তার সাইকোথেরাপিস্ট পাওলো ফ্রাঙ্কিনি বলেন, “আচেরবির বাবা তার সবচেয়ে বড় ফ্যান ছিলেন, আবার সবচেয়ে বড় ঝামেলাও। সব সময় ভুল ধরিয়ে দিতেন।” প্রতিটি ম্যাচের শুরুতে আকাশের দিকে হাত তুলে আচেরবি যেটা করেন, সেটা মূলত তার বাবার জন্য। কিন্তু এ জায়গায় পৌঁছাতে তার পেরোতে হয়েছে অনেক দূর। মিলানে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরেই বাবা মারা যান। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে আচেরবি, ডুবে যান বিষণ্ণতায়।

পরে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে আমার মানসিকতা ঠিক ছিল না। প্রায়ই মাতাল অবস্থায় অনুশীলনে যেতাম, আগের রাতের হ্যাংওভার নিয়ে। শারীরিকভাবে ফিট ছিলাম, সেটাই যথেষ্ট ভাবতাম।

“কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর সব ভেঙে পড়ল। আর কোনো উদ্দীপনা ছিল না, খেলতেও পারতাম না। তখন অসুস্থ হয়ে যা পেতাম তাই খেতাম।” মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মিলান তাকে ফের লোনে পাঠায় কিয়েভোতে, সেখান থেকে সাসুয়োলোর কাছে। কিন্তু সেখানেই আবার ধাক্কা, জুলাই ২০১৩ সালে মেডিকেল পরীক্ষায় ধরা পড়ল টেস্টিকুলার ক্যানসার।

GettyImages-2213782752.jpg

“একদিনেই জীবন বদলে যেতে পারে, হঠাৎই আপনি অসহায় হয়ে পড়েন,” আচেরবি পরে বলেছিলেন। অপারেশন করে টিউমার বাদ দেওয়া হলো, আবার মাঠে ফিরলেন। কিন্তু ডিসেম্বরেই ডোপ টেস্টে অস্বাভাবিক ফল, যা ক্যানসারের ফেরার ইঙ্গিত দিল।

আচেরবি হাল ছাড়েননি। কয়েক দফা কেমোথেরাপির পর, যা তিনি বলেছিলেন “ব্যথা আর সাহসের জগত”, তিনি আবার জয় করলেন ক্যানসারকে। “একভাবে দেখতে গেলে, টিউমার আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিল, কে আমি আর কী চাই, সেটা বুঝিয়ে,” আচেরবি বলেছিলেন।

ঘনিষ্ঠদের সহায়তায় আচেরবি ফিরে এলেন মাঠে, পেলেন স্থিরতা। সাসুয়োলোর হয়ে টানা পাঁচ বছর ভালো খেললেন, ২০১৮ সালে যোগ দিলেন লাজিও। সেখানে দেখা হলো ইনজাগির সাথে, যিনি ২০২২ সালে তাকে ইন্টারে আসতে বলেছিলেন আচেরবির নেতৃত্বগুণের জন্য। ইনজাগি বললেন, “ইন্টার আমাকে শুনেছিল আচেরবিকে নিয়ে। আমি জানতাম ওর মনোযোগ আর জেদ অন্য রকম।”

ক্লাবের ভেতরের সন্দেহ আর রোসোনেরি (মিলান) অতীতের কারণে সমর্থকদের আপত্তি সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে ১০ লাখ ইউরোতে লোনে আনা হলো তাকে। তার মনোবিদ ফ্রাঙ্কিনি বললেন, “আমি নিজেও ওকে ইন্টারে যেতে বলেছিলাম। ওর বাবা ছিলেন ইন্টার সমর্থক, তাই এটা তাদের মধ্যে এক ধরনের মেলবন্ধন।” বড় ম্যাচগুলোর আগে, যেমন বার্সেলোনার বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে, এখনো তারা কথা বলেন।

acerbi

আচেরবির প্রিয় প্রাণী সিংহ। তার গায়ে ট্যাটু করা ‘দ্য লায়ন কিং’, পেটে গর্জন করা সিংহ, আর হাতে মজা করে হাসা অ্যানিমেশন চরিত্র ‘ম্যাডাগাসকার’-এর সিংহ অ্যালেক্স।তিনি কখনো পরাজয় মেনে নেননি। ক্যানসারের মুখোমুখি হয়েছেন, এমনকি জাতীয় দলের কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তির বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন, যিনি প্রায় দুই বছর ডাক দেননি। মার্চে স্পালেত্তিকে যখন আচেরবি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়, তিনি বলেছিলেন, “আচেরবি? জানেন ও কত বয়সী?”

কিন্তু এরপরই স্পালেত্তি তাকে ফেরত ডেকেছেন নরওয়ে আর মলডোভার বিপক্ষে ম্যাচে। দুই বছর আগে ইস্তানবুলে ম্যান সিটি-র কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের দুঃখটাও আচেরবি পুষে রেখেছিলেন। এবার যদি মিউনিখে ইন্টার শিরোপা জেতে, তার কৃতিত্বও আচেরবির।

আচেরবি বলেন, “আমার জীবনের শিক্ষাই হলো, কখনো হাল ছাড়বে না। পড়ে গেলে উঠে দাঁড়াও, সঠিক মানসিকতা নিলে মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠা যায়। নিজেকে সাহায্য করতে শিখতে হবে, বুঝতে হবে যে আপনার সহায়তা দরকার। বাইরের থেকে সহায়তা পেতে শক্তি লাগে, ভাগ্য লাগে ভালো মানুষদের কাছে থাকার জন্য, কিন্তু শুরুটা করতে হয় নিজের ভেতর থেকে।

তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তিগত আর খেলোয়াড়ি দিক থেকে, মিউনিখে জয় আসলেই কোনো চক্র সম্পূর্ণ হবে কিনা জানি না। আমি এমন কেউ নই যে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের পর থেমে যাবে।”

তার শরীরের সিংহের ট্যাটুগুলো আচেরবির সাহস দেখায়, আর পিঠের পাখাগুলো প্রমাণ করে, তিনি উড়ে যেতে শিখেছেন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর