শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সাঈদ আনোয়ারের ভারত দহন

প্রকাশিত: ২১ মে ২০২৫, ০৫:৪৫ পিএম

শেয়ার করুন:

সাঈদ আনোয়ারের ভারত দহন

১৯৭৭ সালের উত্তাল তেহরানে যখন অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তা একাকার, তখন একজন বাবা তার নয় বছরের ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন করাচির পথে স্বস্তির আশায়, জীবনের নিরাপদ কোনে। সেই ছেলের নাম সাঈদ আনোয়ার। ফুটবলের সঙ্গে বেড়ে ওঠা ছেলেটি তখনো জানতো না, তার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে ব্যাট হাতে বিশ্বকে তাক লাগানোর।

তেহরান থেকে করাচি, সেখান থেকে সৌদি আরব, আর সেখান থেকেই ক্রিকেটের মঞ্চে সাঈদ আনোয়ারের আগমন। একসময় স্কোয়াশ আর টেনিস ছিল তার নিত্যসঙ্গী, আর এই খেলাগুলোই যেন নিখুঁতভাবে গড়ে তুলেছিল তার কবজির সেই অসাধারণ শক্তি ও নমনীয়তা। যা তাকে ব্যাট হাতে রূপ দিয়েছিল প্রতিপক্ষ বোলারদের ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে।


বিজ্ঞাপন


সাঈদ আনোয়ার ছিলেন ওপেনিং ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া এক নাম। তিনি মাঠে নামতেন এবং ঝড়ের গতিতে ইনিংস শুরু করতেন। কিন্তু, ভিন্নতায় ছিল তার সৌন্দর্য। আক্রমণাত্মক হলেও তার ব্যাটিং ছিল শিল্পসুষমায় মোড়া। যেন চোখের আরাম, যেন সুরের খেল।

অনেকে সানাথ জয়সুরিয়া বা মাইকেল স্ল্যাটারের কথা বলেন, কিন্তু শান্ত স্বভাবের সাঈদ আনোয়ার তাদের চেয়েও আলাদা। ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন কবি, যার প্রতিটি শট ছিল পঙক্তির মতো নিখুঁত। এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান তো বলেই ফেলেছিলেন, ‘টেন্ডুলকার আর লারার মাঝখানে রাখবো আমি ওকে। কারণ বলের টাইমিং এমন করে আর কেউ বুঝত না।’

saeedbday_b_05

সাফল্য, স্টাইল আর সংগ্রাম- ভারতকে দুমড়ে মুচড়ে সাঈদের ১৯৪


বিজ্ঞাপন


ইংল্যান্ডে ১৭৬ রানের ইনিংস কিংবা চেন্নাইয়ে ভারতের বিপক্ষে করা অবিশ্বাস্য ১৯৪ রান। সাঈদ আনোয়ার শুধুই স্কোর বোর্ড নয়, ভিজিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেট প্রেমীদের হৃদয়। তার স্ট্রোকের বৈচিত্র্য, টাইমিংয়ের নিখুঁততা আর প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বোঝার ক্ষুরধার ক্ষমতা তাকে দিয়েছে অনন্য আসন।

২১ মে, ১৯৯৭-  এই দিনটি ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে পাকিস্তানের বাঁহাতি ওপেনার সাঈদ আনোয়ারের দুর্দান্ত ১৯৪ রানের ইনিংসের কারণে। ভারতের বিপক্ষে চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে তিনি খেলেছিলেন এক অসাধারণ ১৯৪ রানের ইনিংস, যা তখনকার ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল।

চেন্নাইয়ের প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ অবস্থায় ব্যাট করতে নামা আনোয়ার একদিকে যেমন আগ্রাসী ছিলেন, অন্যদিকে তেমন ধৈর্য দেখিয়েছিলেন। ১৪৬ বলের এই ইনিংসে ছিল ২২টি চার ও ৫টি ছক্কার মার। ভারতের ঘরের মাঠে এমন এক ইনিংস খেলায় দর্শকরাও দাঁড়িয়ে করতালি দিয়েছিল।

এই ইনিংসটি ভেঙে দেয় স্যার ভিভ রিচার্ডসের ১৮৯ রানের রেকর্ড, যা তিনি করেছিলেন ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। ভিভের সেই রেকর্ড টিকে ছিল ঠিক ১৩ বছর। ঠিক ততদিনই টিকে ছিল সাঈদ আনোয়ারের রেকর্ডও ২০১০ সালে শচীন টেন্ডুলকার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করেন।

saeed-anwar_h

সাকলায়েন মুশতাক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সাঈদ ভাই বোলারের হাত থেকে বল ছাড়ার আগেই বুঝে যেতেন বলটা কোথায় পড়বে, কেমন হবে লেংথ।’এমন দূরদর্শিতা খুব কম ব্যাটসম্যানেরই ছিল।

তবে তার ক্যারিয়ারটা ছিল বারবার ইনজুরি আর প্রত্যাবর্তনের গল্প। হাঁটুতে চোট, অস্ত্রোপচার, বারবার ফিরে আসা; আর বারবার নতুন করে প্রমাণ করা যে তিনি এখনো শেষ হয়ে যাননি।

যখন জীবন খেলাটা থামিয়ে দেয়

সব কিছুর ঊর্ধ্বে, এক ভয়ানক ঘটনা যেন সবকিছু বদলে দেয়। নিজের একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে সাঈদ আনোয়ারের জীবন একেবারে বদলে যায়। ক্রিকেট তখন আর খেলা থাকে না তার জন্য, হয়ে ওঠে দূর কোনো অতীত।

বেশ কয়েক মাস মাঠ থেকে দূরে থাকার পর যখন আবার তিনি মাঠে ফিরে এলেন, সবাই দেখলো এক ভিন্ন সাঈদ আনোয়ারকে। দাঁড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখ, শান্তভাবে চোখ নামিয়ে চলা একজন মানুষ, যিনি ক্রিকেট ছাড়িয়ে অনেক বড় কিছু ভাবেন এখন।

11845

সমালোচনার খড়গ সয়েছেন, বিদায়বেলায় আর রাজকীয় কোনো বিদায় পাননি। বরং সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘দুই বছর হয়তো খেলতে পারতাম, কিন্তু বোঝানো হলো আমাকে আর দরকার নেই।’

ক্রিকেট থেকে অবসরের পর পিসিবি তাকে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব দিতে চাইলেও সাঈদ নিজেই তা ফিরিয়ে দেন। কারণ, ‘ন্যায়বিচার করতে পারবো না’, এমন স্পষ্ট স্বীকারোক্তি তার সরলতা আর সততার পরিচয়।

একজন ব্যাটসম্যানের চেয়েও বেশি

সাঈদ আনোয়ার কেবল একজন সফল ওপেনার ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। যার ব্যাটিং দেখলে মনে হতো ক্রিকেটটা যেন এক শিল্প। কিন্তু তিনি নিজে জানতেন, সেই শিল্পের পেছনে আছে অধ্যবসায়, আত্মত্যাগ আর অন্তর্দহন।

তার বিদায়টা হয়তো হলিউডের সিনেমার মতো নয়, কিন্তু জীবনটা ঠিক যেন বাস্তবতার ছায়ায় লেখা এক মহাকাব্য। যে কাব্য পড়ে বারবার মনে পড়ে যায়- আলো সবসময়ই ছায়ার ওপারে থাকে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি উর্দু, আরব নিউজ, খেলাধুলাবিষয়ক পুরোনো সাক্ষাৎকার ও সহখেলোয়াড়দের মন্তব্য।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর