৭৭০ রান। হ্যাঁ, মাত্র সাতশো ৭০ রান দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিরাট কোহলি। টেস্ট ইতিহাসের দশ হাজার রানের অনন্য মাইলফলকের সামনে। আর ঠিক তখনই, যেন রাজা তাঁর তরবারি নামিয়ে রাখলেন অবলীলায়, নির্ভারভাবে।
এই চলে যাওয়ায় ছিলো না কোনো আনুষ্ঠানিক অবসর ঘোষণা, ছিলো না ফেয়ারওয়েল ট্যুরের চাকচিক্য, ছিল না ক্যামেরার সামনে কান্নাভেজা বিদায় ভাষণ। বরং কোহলির বিদায় ছিলো এক নিঃশব্দ বজ্রপাত শূন্যতার গর্জন, শ্রদ্ধার দীর্ঘশ্বাস, ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানোর নীরব মুহূর্ত।
বিজ্ঞাপন
তবে বিরাট কোহলির এই রাজত্বের শুরু হয়েছিল লড়াই দিয়ে। ১৮ বছরের এক তরুণ, দিল্লির হয়ে মাঠে নামছে। প্রতিপক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে খেলছে অপরাজিত এক ইনিংস। রাতে বাবার অসুস্থতার খবর আসে। ভোরে বাবা মারা যান। অথচ পরদিন সেই কিশোর ব্যাট হাতে নামেন মাঠে। ২৩৮ বল খেলে করেন ৯০ রান। ম্যাচ শেষ করে গিয়েছিলেন বাবার শেষকৃত্যে।

সেদিনই ক্রিকেট জগতে জন্ম নেয় এক লড়াকু চরিত্রের। যিনি পরিবার, আবেগ, দুঃখ সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে খেলে যান শুধুই দেশের জন্য।
তবে প্রথমদিককার কোহলি ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। অল্প বয়স, আগ্রাসী মানসিকতা, স্লেজিংয়ে জড়ানো, অধিনায়কত্ব নিয়ে দ্বিধা, ব্যাট হাতে অনিয়মিত পারফরম্যান্স। সব মিলিয়ে ভারতের ক্রিকেটে জার্সি নাম্বার ১৮ ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ এক নাম।
বিজ্ঞাপন
তবে ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন। হয়ে ওঠেন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল টেস্ট অধিনায়ক। লাল বলের ক্রিকেটে ৩০টা শতরান। ৩১টা হাফ-সেঞ্চুরি। সাতটা ডাবল সেঞ্চুরি। ২০ টা শতরান করলেন অধিনায়ক হিসেবে। যা ভারতীয় ক্রিকেটে অনন্য। তবু থেমে গেলেন। ১০ হাজার রানের মাইলফল থেকে মাত্র ৭৭০ রান বাকি থাকতে।

রাজারা বুঝি এমনই হয়! কোহলি জানতেন, ক্রিকেট শুধুই খেলা নয়, এটা যুদ্ধ। আর যুদ্ধ সবসময় বিজয়ের জন্য হয় না, হয় সম্মানের জন্য। যখন সেই সম্মান পাওয়া সম্পূর্ণ হয়, তখন আর নিজেকে প্রমাণের কিছু থাকে না।
তিনি চাইলেন না আরও একটা সিরিজ, আরও একবার মাঠে নামা, কিংবা একটা ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। কারণ তিনি হয় তো বিশ্বাস করতেন, রাজা সত্যিকারের শাসক, তাঁকে বিদায় জানানোর প্রয়োজন পড়ে না। ইতিহাস নিজেই তাঁর পদধ্বনি ধরে রাখে চিরদিন।
না হয়, কোহলি কখনো শুধু রান করতে মাঠে নামেননি। তিনি খেলতেন দেশের জন্য, দলের জন্য, সম্মানের জন্য। তাঁর চোখে ছিল আগুন, তাঁর ব্যাট ছিল তরবারি, মাঠে তিনি ছিলেন এক যোদ্ধা। আর যখন বুঝলেন, যুদ্ধ যথেষ্ট হয়েছে, অবলীলায় বললেন, 'যথেষ্ট'। একটা শব্দেই শেষ করে দিলেন এক রাজত্ব।

এই বিদায় ছিল না শুধুই একজন ক্রিকেটারের, বরং একটা পুরো প্রজন্মের বিদায়। যে প্রজন্ম বড় হয়েছে কোহলির আগ্রাসন দেখে, তাঁর শতরান দেখে, তাঁর স্লেজিং দেখে, তাঁর ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং দেখে।
বিদায়ে বেলা তাই হয়তো কোহলি নতুন প্রজন্মকে একটু ভিন্ন করেই বার্তা দিয়ে গেলেন, মনে করিয়ে দিলেন, আমাদের দাদুর প্রজন্ম অবসর নিতো ৬০-এ, বাবার প্রজন্ম ৫০-এ, আর আমাদের প্রজন্মের রাজারা সরে যান ৩৬-এ। এভাবেই শ্রেষ্ঠত্বকে রক্ষা করতে হয়, সময় থাকতেই নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার নামই তো ‘রাজসিক বিদায়’।
তাঁর ব্যাট আর উঠবে না দশ হাজার রানের গৌরব ছোঁয়ার জন্য। তবে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন সেই প্রতিটি তরুণের মাঝে, যারা ব্যাট হাতে নামার আগে মনে মনে বলে, আমি বিরাট কোহলি হতে চাই।

