‘এল ক্লাসিকো’ মানেই উত্তেজনার পারদ চড়ে আকাশে। রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সেলোনার মুখোমুখি লড়াই শুধু স্পেন নয়, পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তবে এবারের ক্লাসিকোটা একটু আলাদা। কারণ, লা লিগার শিরোপা নির্ধারণ হতে পারে এই ম্যাচ দিয়েই।
রোববার বার্সেলোনার অলিম্পিক স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হচ্ছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। লিগের ৩৫তম ম্যাচ। বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ১৫ মিনিটে শুরু হবে ম্যাচ। দুই দলই এখন পর্যন্ত শিরোপা জয়ের দৌড়ে আছে। এই ম্যাচে হেরে গেলে শুধু শিরোপা হাতছাড়া নয়, প্রতিপক্ষের হাতে ট্রফি দেখে কষ্টে পুড়তে হবে। লামিন ইয়ামাল কিংবা কিলিয়ান এমবাপ্পের মতো তারকাদের কাছে এটুকুই বড় অনুপ্রেরণা।
বিজ্ঞাপন
এই মৌসুমে রিয়ালের বিপক্ষে খেলা প্রতিটি ম্যাচেই জিতেছে বার্সা। তাই কোচ হ্যান্সি ফ্লিকের প্রথম মৌসুমটা ট্রফি ছুঁয়ে শেষ না হলে সেটা হতাশারই নামান্তর। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে ইন্টার মিলানের কাছে নাটকীয় হারে ছিটকে পড়ার পর এই ট্রফি জেতা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে রিয়ালের জন্য ট্রফিহীন মৌসুম একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আর সেটাই হতে যাচ্ছে কোচ কার্লো আনচেলত্তির সম্ভাব্য বিদায়ী বছরের রূঢ় বাস্তবতা।
কেন এত বড় হয়ে উঠেছে এবারের ক্লাসিকো?
এই মৌসুমে এর আগে তিনবার মুখোমুখি হয়েছে দুই দল। প্রতিবারই ম্যাচটা আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে এবার যেন পুরো মৌসুমটাই তৈরি হয়েছে এই এক ম্যাচের জন্য।
ক্লাসিকো সাধারণত মার্চ বা এপ্রিলেই হয়, যাতে লিগের ভাগ্য নির্ধারণের সম্ভাবনা থাকে। শেষ ৩০ বছরে মে মাসে এত দেরিতে ক্লাসিকো হয়েছে মাত্র একবার, ১৯৯৫ সালের ২৭ মে, যেখানে বার্সা জিতলেও শিরোপা নিয়েছিল রিয়াল। এবার সেই নজির আবার তৈরি হচ্ছে, ম্যাচডে ৩৫-এ এসে এখনো নিশ্চিত নয় কে হবে চ্যাম্পিয়ন। বার্সা এগিয়ে চার পয়েন্টে। জিতলে শিরোপার এক হাত ধরেই ফেলবে। রিয়াল চাইবে এই ম্যাচ জিতে ঘুরে দাঁড়াতে, তারপর আশা করে থাকবে বার্সা যেন পরের তিন ম্যাচে হোঁচট খায়।
বিজ্ঞাপন
এই ম্যাচ সামনে এনে দেয় আরও কিছু ঐতিহাসিক ক্লাসিকোর স্মৃতি। ২০১২ সালে ক্যাম্প ন্যুতে রোনালদোর 'ক্যালমা ক্যালমা' উদযাপন, ম্যাচজয়ী গোল, লিগ শিরোপা-সবকিছুতেই আলোড়ন তুলেছিল। আর ২০০৯ সালের ৬-২ ব্যবধানের জয়? সেটাও ছিল গার্দিওলার বার্সেলোনা যুগের এক অনন্য মুহূর্ত।
তেমন কিছু কি হবে এবার? ফুটবলপ্রেমীরা তো আশা করতেই পারে।
মৌসুমটা এভাবে এল কিভাবে? যখন লিগ সূচি প্রকাশ হয়েছিল, তখন অনেকেই ভেবেছিল মে মাসের ক্লাসিকোটা হয়তো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। বাস্তবে হয়েছে ঠিক উল্টো। শেষ পর্যন্ত এসে এই ম্যাচটাই হয়ে উঠেছে মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ।
বার্সা শুরুটা দারুণ করেছিল। গত অক্টোবরে রিয়ালকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ছয় পয়েন্টে এগিয়ে যায়। তখন অ্যাতলেটিকো ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে। এরপর হঠাৎ করেই বার্সা ছন্দ হারিয়ে বসে, সাত ম্যাচে মাত্র এক জয়, অ্যাতলেটিকোর কাছে হারে। এই ফাঁকে শীর্ষে উঠে আসে সিমিওনের দল।
কিন্তু তারাও ছন্দ ধরে রাখতে পারেনি, সুযোগ পায় রিয়াল। জানুয়ারিতে ভায়োদোলিদের বিপক্ষে জয়ের পর রিয়াল এগিয়ে যায় বার্সার থেকে সাত পয়েন্টে। তখন মনে হচ্ছিল ট্রফি সহজেই পাচ্ছে তারা। কিন্তু না, এরপর তারাও খেই হারিয়ে ফেলে।
ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে পাঁচ ম্যাচে মাত্র এক জয় রিয়ালের। এই সময়ে বার্সা আবারও নিজেদের খুঁজে পায়। এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবল বার্সা ও রিয়াল।
২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ১৫ ম্যাচে ১৩ জয় ও ২ ড্র বার্সার। ফাইনালে রিয়ালকে হারিয়ে সুপারকাপ জয়, কোপা দেল রে’তেও জয়। সব মিলিয়ে এবার তাদের সামনে দ্বিতীয় লিগ ট্রফি জয়ের সুবর্ণ সুযোগ।
বার্সার জন্য কী ঝুঁকি?
এই মৌসুমে বার্সার সাফল্য অনেকটাই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। সুপারকাপ ও কোপা দেল রে জয়, চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০১৯ সালের পর প্রথম সেমিফাইনাল, তরুণ দল নিয়ে এসবই অনেক বড় অর্জন।
কিন্তু এখন প্রত্যাশার পাল্লা আরও ভারী। লামিন ইয়ামাল তারকা হয়ে উঠেছেন, রাফিনিয়া গোল-সহায়তায় চমক দেখিয়েছেন, লেভানডোভস্কি ৩৭ বছরেও দারুণ ছন্দে, পেদ্রি ফিট হয়ে মাঝমাঠে দাপট দেখাচ্ছেন। সবই সম্ভব হয়েছে হ্যান্সি ফ্লিকের আক্রমণাত্মক ফুটবল দর্শনে। যদিও ইন্টার মিলানের কাছে হারের পর সেই দর্শনে কিছু ঘাটতি চোখে পড়েছে।
তবে এই ক্লাসিকোতে জয় পেলে সেই হতাশা অনেকটাই কাটিয়ে উঠবে। রিয়ালকে চতুর্থবার হারিয়ে লিগ শিরোপা নিশ্চিত করার সুযোগ এখন তাদের সামনে। হেরে গেলে কিন্তু মৌসুমের সব অর্জনই ম্লান হয়ে যেতে পারে।
রিয়ালের জন্য কী ঝুঁকি?
রিয়ালের জন্য এই ম্যাচ সবকিছু। এই ক্লাসিকো জিততে না পারলে, পুরো মৌসুমটা ব্যর্থতা হিসেবেই ধরা হবে। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে ছিটকে পড়া রিয়ালের জন্য বড় ধাক্কা। তবে ভাগ্যক্রমে অন্তত বার্সা চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করেনি, সেটাই কিছুটা স্বস্তি।
জিতলে রিয়াল লা লিগা জয়ের দাবিদার হয়ে উঠবে, বার্সার চেয়ে বড় মৌসুম বলে দাবি করতে পারবে।
এদিকে আনচেলত্তির বিদায় প্রায় নিশ্চিত, তিনি ব্রাজিল দলে যাচ্ছেন। তবে এই মৌসুমের পর কতটা দল ঢেলে সাজানো হবে, সেটা নির্ভর করছে এই ক্লাসিকো আর বাকি তিন ম্যাচের ফলাফলের ওপর। ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আর্নল্ডের আগমন প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু আরও বড় চুক্তি হবে কিনা, সেটা ঠিক করবে এই ক্লাসিকো।
কীভাবে বদলাবে শিরোপার সমীকরণ?
বার্সা জিতলে
তাদের পয়েন্ট দাঁড়াবে ৮২, রিয়ালের থাকবে ৭৫। তখন বার্সার দরকার হবে আর মাত্র এক জয়। বৃহস্পতিবার এসপানিওলের মাঠে সেই সুযোগ থাকবে। তবে রিয়াল আগের দিন মায়োর্কার বিপক্ষে পয়েন্ট হারালে বার্সা আগেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে।
রিয়াল ড্র করলেও, বার্সা ৮২ পয়েন্টে পৌঁছে গেলে হেড টু হেড বিবেচনায় এগিয়ে থাকবে। কারণ প্রথম লিগ ক্লাসিকোয় ৪-০তে জিতেছিল বার্সা।
ম্যাচ ড্র হলে
বার্সা থাকবে ৮০ পয়েন্টে, রিয়াল ৭৬-এ। তখন তিন ম্যাচে রিয়ালের চাই ছয় পয়েন্ট, আর বার্সার হারাতে হবে অন্তত পাঁচ পয়েন্ট। যদিও কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
রিয়ালের সামনে তখন অপেক্ষাকৃত সহজ তিন প্রতিপক্ষ, মায়োর্কা, সেভিয়া আর রিয়াল সোসিয়েদাদ। আর বার্সাকে খেলতে হবে এসপানিওল, ভিয়ারিয়াল ও অ্যাথলেটিক ক্লাবের মতো কঠিন দলের বিপক্ষে।
রিয়াল জিতলে
তাহলে শিরোপার হিসাব পুরোপুরি খুলে যাবে। বার্সা থাকবে ৭৯ পয়েন্টে, রিয়াল ৭৮-এ। তখন সামনের তিন ম্যাচে যারা কম ভুল করবে, ট্রফি উঠবে তাদের হাতে।
রিয়াল তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ পাবে, আর বার্সার তিনটি ম্যাচই কঠিন। যদি রিয়াল চার গোলের ব্যবধানে জেতে, তাহলে বার্সা হারাবে হেড টু হেড সুবিধাটিও।
পিচিচির লড়াই: লেভা বনাম এমবাপ্পে
লা লিগায় ব্যক্তিগত লড়াইয়েও উত্তেজনা তুঙ্গে। লেভানডোভস্কি ও এমবাপ্পে এখন পিচিচির দৌড়ে একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি।
৩৪ ম্যাচে বার্সা করেছে ৯১ গোল, যার ২৫টিই লেভার। এমবাপ্পে পিছিয়ে ছিল, কিন্তু এখন মাত্র এক গোলের ব্যবধানে (২৪ গোল) উঠে এসেছে। পেনাল্টি থেকে এমবাপ্পের গোল ছয়টি, লেভার তিনটি।
এই ক্লাসিকো কি নির্ধারণ করবে শিরোপার ভাগ্য? নাকি আরও নাটক জমা থাকবে শেষ মুহূর্তের জন্য? অপেক্ষা শুধু রোববার রাতের।

