বাংলাদেশের ক্রিকেটে ২০২৩ সালটি যেন ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অথচ এই বছরটিই হতে পারতো তামিম ইকবালের জন্য স্মরণীয় একটি গল্প লেখার দৃশ্যপট। যা তিনি নিজ হাতেই দূরে ঠেলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের দেশসেরা এই ওপেনারকে নিয়ে এতো নাটকীয়তার শেষ পেরেকটা গতকাল ঠুকে দিয়েছে বিসিবির একটি ভিডিও বার্তা। দীর্ঘ সময় ধরে ওয়ানডে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সুপার লিগের তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশকে নিয়ে যান তামিম। স্বপ্ন দেখছিলেন বিশ্বকাপে এবার অবিস্মরণীয় কিছু করার। কিন্তু সবকিছুই যেন "৬,৭,৩,৩,২১,২৬" এই সংখ্যাগুলোর কাছে পেন্ডুলামের মতো ঘুরে গেল।
গতকাল অভিনব কায়দায় বিশ্বকাপের ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করে টাইগার ক্রিকেট বোর্ড। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডের পর বিসিবি এক ভিডিও বার্তায় বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করে। যেখানে প্রতি ক্রিকেটার তাদের বিশ্বকাপ জার্সি গ্রহণ করেন। অথচ যে দলটিকে এতোদিন আগলে রেখে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যিনি, সে তামিম ইকবাল ছাড়াই চূড়ান্ত হয়েছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল।
বিজ্ঞাপন
৬ জুলাই ২০২৩
তামিমের এভাবে দেশের ক্রিকেট থেকে দূরে চলে যাওয়ার সূত্রপাত জুলাইয়ের ৬ তারিখ। সেদিন চট্টগ্রামের একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ছিলেন তামিম। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ চলমান ছিল ততক্ষণে ক্রিকেট পাড়ায় গুঞ্জন রটে যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলতে যাচ্ছেন দেশসেরা ওপেনার। অবশেষে কান্নাভেজা চোখে কোনো কারণ উল্লেখ না করেই অবসরের ঘোষণা দেন তামিম। বাংলার ক্রিকেটে তখন যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হঠাৎ দলের অধিনায়ক ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিলেন। কি এমন হয়েছিল অন্দর মহলে আজও তা পরিষ্কার করে বলেননি তামিম। 
৭ জুলাই ২০২৩
তামিমের আচমকা অবসরের ঘোষণায় তোলাপাড় ক্রিকেট পাড়ায়। বিশ্ব মিডিয়াও অবাক হয়েছিল বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ২২ গজকে বিদায় জানানোর পর। তামিমের এমন সিদ্ধান্তে তার ভক্তরা পর্যন্ত সড়কে নেমে পড়ে। সেই সঙ্গে টাইগার ক্রিকেটের অন্যতম ভক্ত টাইগার শোয়েবের রাস্তায় গড়িয়ে হাউমাউ করে কান্নার দৃশ্যগুলো দাগ কেটে যায় সকলের মনে। তামিম ইকবালের অবসরের খবর পৌঁছে যায় দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। তারপর ৭ জুলাই যা হল তা সবারই জানা। আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার ঘোষণা দেন টাইগার ওপেনার।
বিজ্ঞাপন

৩ আগস্ট ২০২৩
অবসর ঘোষণার আগে থেকেই নিজের পিঠের চোটের জন্য অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তামিম। যার জন্য তাকে ইংল্যান্ড গিয়ে চিকিৎসাও করাতে হয়। ফলে বাংলাদেশের হয়ে একাধিক ম্যাচ তিনি খেলতে পারেননি। সামনেও কবে শতভাগ ফিট হয়ে ফিরবেন তা নিয়েও ছিল শঙ্কা। ফলে লম্বা সময় ধরে তাকে ২২ গজে পাবে না টিম টাইগার্স। তাই দেশের ও দলের কথা বিবেচনা করে ৩ আগস্ট ওয়ানডের অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তামিম। দলের ভবিষৎ ভেবেই পেছনে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন ফিট হয়ে আবারো টাইগার জার্সিতে তিনি খেলা চালিয়ে যাবেন শুধু অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও পরিষ্কার করেন তামিম আসন্ন এশিয়া কাপে দলের সঙ্গে থাকবেন না তিনি। চালিয়ে যাবেন নিজের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া।

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ড সিরিজ দিয়ে দীর্ঘ দুই মাসেরও অধিক বিরতির পর মাঠের ক্রিকেট ফিরেন তামিম। নির্বাচক থেকে ধরে ক্রিকেট বিশ্লেষক সবার দৃষ্টি ছিল তামিমের দিকে। চোট কাটিয়ে ম্যাচ খেলার জন্য কেমন প্রস্তুত তামিম। সেই পরীক্ষায় দুই ম্যাচ খেলে ভালোভাবেই উতরে যান ড্যাশিং এই ওপেনার। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৪ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস খেলার পর সকলেই ধারণা করে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপ দলে এবার তাহলে তামিম থাকছেনই। তবে দ্বিতীয় ওয়ানডে শেষে নিজের ফিটনেস নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন তামিম যা নির্বাচকদের জানিয়েছিলেন। বিশ্বকাপে দল দেওয়ার আগে যেন সেই বিষয়টি নির্বাচক প্যানেল বিবেচনায় রাখে।
তবে এরপরই তামিম ইকবালের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে শরৎকালের মতো হঠাৎ রোদের মাঝে বৃষ্টির আবির্ভাব। ২৫ সেপ্টেম্বর মাঝরাতের খবর বিশ্বকাপ দলে তামিমকে চান না হেড কোচ হাথুরুসিংহে ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। যার পেছনের অন্যতম কারণ তামিম ইকবালের ফিটনেস। শতভাগ ফিট না হলে তাকে নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে চান না সাকিব। বিসিবি সভাপতির বাসায় মাঝরাতে হেড কোচ ও টাইগার অধিনায়কের রুদ্ধদার বৈঠক।

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম একদিন, কারণ সেদিনই জানা যাবে ভারত বিশ্বকাপের বিমান ধরছেন কারা। আবার এদিন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টাইগারদের সিরিজের সবশেষ ওয়ানডেও। মিরপুরে চলমান ওয়ানডের মাঝপথে চারিদিকে মিশাইলের মতো ছড়িয়ে পড়ে তামিমকে ছাড়াই ঘোষিত হচ্ছে বিশ্বকাপের দল। বিসিবি জানাল বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বকাপের স্কোয়াড দেওয়া হবে। তবে ফের বাঁক কেটে বসে টাইগার ক্রিকেট বোর্ড। জানানো হয় চলমান নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশ ম্যাচ শেষে ঘোষণা হবে বিশ্বকাপ দল। অবশেষে তাই হলো, ঘোষিত দলে সেই গুঞ্জনের কথায় সত্য হলো। তামিম ইকবালকে ছাড়া বিশ্বকাপ মাতাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
ক্রিকেট পাড়ায় তোলাপড় তামিম রেখেই বিশ্বকাপ যাত্রায় কিভাবে যাচ্ছে টিম টাইগার্স। এই দলটি এতোদিন ঘুচিয়ে আনা সেই ব্যক্তিকে ছাড়াই ভারতের বিমান ধরবে বাংলাদেশ। দল ঘোষণার পর নির্বাচকরা সাংবাদিকদের পরিষ্কার জানিয়ে দেন তামিমের ইনজুরি নিয়ে তারা ঝুঁকি নিতে চাননি। এটিই কি আসলে প্রকৃত কারণ তাহলে?
সেদিন রাতেই বিভিন্ন সূত্রের খবর থেকে সংবাদ আসে টিম ম্যানেজম্যান্ট তামিমকে পুরো বিশ্বকাপ খেলাবেন না বলে তাকে জানিয়েছিলেন। এই বিষয়টি তিনি ভালোভাবে নিতে পারেননি। এমনকি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে তিনি খেলতে চাইলে তাকে মিডেল অর্ডারে খেলতে হবে। এমন প্রস্তাব তাকে দিয়েছিলেন খোদ বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

দীর্ঘ ১৭ বছর ক্রিকেট খেলা এই তারকা ব্যাটার টিম ম্যানেজম্যান্টের এমন সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নিতে পারেননি তাই বিশ্বকাপ দলে তাকে না রাখার জন্য বলেন তিনি। তবে প্রশ্ন দাঁড়ায় অনেকগুলো।
বিসিবি কতটা পেশাদার হলে তাদের ম্যাচ পরিকল্পনা সেই ভেন্যুতে না গিয়েই আগে করে ফেলে?
১৭ বছর ক্রিকেট খেলা একজন ব্যাটারকে প্রতিপক্ষের ডানহাতি স্পিনারের জন্য তাকে দল থেকে বাদ দিতে বলা অথবা মিডেল অর্ডারে খেলার প্রস্তাব দেওয়া কতটা যুক্তিসংঘত?
যদি টিম ম্যানেজম্যান্টের ভাবনা এমনই হয় তাহলে পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে তামিমকে সেই বিষয়টি জানানো উচিত ছিল হেড কোচ অথবা অধিনায়কের?
বিসিবি সভাপতি নিজে তামিমকে এমন প্রস্তাব দিয়ে কতটুকু পেশাদারিত্বের প্রমাণ রেখেছেন?
৩ আগস্ট তামিম যখন দল থেকে সরে দাঁড়ান তখনই জানা গিয়েছিল বিশ্বকাপে তামিম খেললেও তিনি শতভাগ ফিট থাকবেন কিনা তা অনিশ্চিত, তাহলে দল ঘোষণার একদিন আগে কেন তামিমকে ফিটনেস ইস্যুতে সরিয়ে দেওয়া হলো?
এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর অজানা। ক্রিকেট ভক্তদের থেকে বিশ্লেষক সকলেরই বিসিবির এমন কাণ্ডের উত্তর জানা নেই। তবে এমন সময়ের পরিক্রমায় কি তাহলে তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সমাপ্তি ঘটল?
যদি নাও ঘটে তাহলেও তামিম কি ভুলতে পারবেন তার ক্যারিয়ারের এই "৬,৭,৩,২১,২৬" সংখ্যা্গুলো। যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে তামিমের স্বপ্ন যাত্রাকে থামিয়ে দিয়ে তার ওল্ড ডিওএইচএসের বাসার দেয়ালের মাঝে তাকে আবদ্ধ রেখেছে।
এমএএম

