রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সুন্দর আচরণের প্রতিদান

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০২:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

সুন্দর আচরণের প্রতিদান

উঁচু-নিচু, সাদা-কালো সবার সঙ্গে সুন্দর ও শোভনীয় আচরণের নির্দেশ দেয় ইসলাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুন্দর ও উত্তম কথা বলার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন—‘তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম ও সুন্দর কথা বলো।’(সুরা বাকারা: ৮৩)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলের কারণে মানুষ বেশি জান্নাতে যাবে? তিনি বললেন, আল্লাহভীতি ও সুন্দর আচরণ।’ (তিরমিজি: ২০০৩)


বিজ্ঞাপন


অন্যের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলাকেও গুরুত্ব দিতে বলেছেন মহানবী (স.)। ‘ভালো কাজের ছোট অংশকেও অবজ্ঞা করো না, যদিও তা তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাতের মাধ্যমে হয়’ (রিয়াজুস সালেহিন: ৬৯৪)। শুধু তাই নয়, ইসলামে সুন্দরভাবে কথা বলা সদকার সমতুল্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন—

 ‘সূর্য উদিত হওয়া প্রতিটি দিবসেই মানুষের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর সদকা দেওয়া আবশ্যক হয়। দুজনের মধ্যে বিবাদ নিরসন করা সদকার সমতুল্য। কাউকে বাহনে উঠতে কিংবা কোনো সামগ্রী বাহনে তুলে দিতে সাহায্য করা সদকা। সুন্দর কথা বলা সদকা। নামাজে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ সদকা। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা সদকা।’ (মুসলিম: ১০০৯)

মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে বিনয়ী হয়ে ও নম্রভাবে। এটি রাসুল (স.) শ্বাশ্বত ও চিরন্তন সুন্নত। আর দুর্বোধ্যতা ও অহংকারের সঙ্গে কথা বলা ইসলামে নিষিদ্ধ। বাচাল ও অহংকারীদের অপছন্দ করেন রাসুলুল্লাহ (স.)। ‘তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ও কেয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে যে তোমাদের মধ্যে অধিকতর সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। আর আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ও আমার কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে থাকবে বাচাল ও অহংকারী।’ (তিরমিজি: ২১০৮)

এক হাদিসে রাসুল (স.) তার প্রিয় সাহাবি হজরত আনাস বিন মালিক (রা.)-কে বলেছেন—


বিজ্ঞাপন


হে বৎস! তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তুমি সকাল সন্ধ্যা এমন অবস্থায় অতিবাহিত করবে যে, তোমার অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই। কারণ এটি আমার সুন্নাহ। আর যে আমার সুন্নাহকে জিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে, সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে। (তিরমিজি: ২৬৭৮)

কারও ভুলের জন্যে কষ্টদায়ক কথা বলা উচিত নয়। সুন্দর কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে বলা শিখিয়েছেন মহানবী (স.)। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে মসজিদে অবস্থান করছিলাম। ঠিক তখন একজন গ্রাম্যলোক এসে মসজিদে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে শুরু করল। সাহাবিরা তাকে বললেন, থামো, থামো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাকে প্রস্রাব করতে বাধা দিয়ো না, তাকে ছাড়ো। পরে রাসুলুল্লাহ (সা.) লোকটিকে কাছে ডাকলেন এবং সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন, মসজিদ আল্লাহর ঘর; এটা প্রস্রাব করার বা নোংরা করার জায়গা নয়। বরং এটা আল্লাহর জিকির, নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতের স্থান।’ (সহিহ মুসলিম: ৬৮৭)

লোকটি নবী কারিম (স.)-এর এমন অমায়িক আচরণের প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। অন্যরা যেখানে তাকে ধমক দিয়ে থামাতে চেয়েছিলেন, সেখানে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মার্জিত উপদেশ তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, হাদিসে এসেছে পরে লোকটি তার ভুল অনুধাবন করে বলেছিলেন, ‘আমার পিতামাতা তার জন্য উৎসর্গ হোক। তিনি আমাকে ধমকও দিলেন না, গালমন্দও করলেন না।’

ছোট্ট জীবনে আসলে মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করাই সমীচীন। এটি মানুষের কাছে মানুষের অধিকার। আর এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না। পিতা মাতা, আত্মীয় স্বজন, এতিম ও দরিদ্রদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার তথা সুন্দর আচরণ করবে এবং মানুষের সঙ্গে সুন্দর কথা বলবে।’ (সুরা বাকারা: ৮৩)

অন্যদিকে, নামাজ-রোজা পালন করেও একজন খারাপ আচরণকারীর ঠিকানা হতে পারে জাহান্নাম। একবার রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সামনে দুজন মহিলার কথা আলোচনা করা হলো। তাদের একজন রাতভর ইবাদত করেন এবং  দিনে রোজা রাখেন, কিন্তু প্রতিবেশীকে কষ্ট দেন। বিশ্বনবী (স.) বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। অপরজন বেশি নফল নামাজ পড়েন না, বেশি নফল রোজাও রাখেনা না। শুধু দ্বিনের ফরজ-ওয়াজিবগুলো আদায় করেন। কিন্তু তিনি প্রতিবেশীকে কষ্ট দেন না। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, সে জান্নাতে যাবে।

অন্যের আরামের দিকে লক্ষ রাখা, কষ্ট না দেওয়া সুন্দর আচরণের অন্যতম দিক। সহিহ মুসলিমে হজরত মিকদাদ (রা.) থেকে দীর্ঘ এক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে—

কয়েকজন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসেছিলেন। তারা রাতে মসজিদে থাকতেন। রাতে যখন আল্লাহর রাসুল (স.) মসজিদে আসতেন, তখন এমন কণ্ঠে সালাম দিতেন, যাতে ঘুমন্ত মানুষের ঘুম না ভাঙ্গে এবং জাগ্রত মানুষ শুনতে পারে। وكان يسلم تسليما لايوقظ نائما ويسمع اليقظان

সুবহানাল্লাহ! কারো ঘুম ভেঙে যাচ্ছে কিনা সেটাও লক্ষ্য রাখতেন বিশ্বনবী (স.)! আর আমরা? আমাদের বেলায় কখনও এমন হয় যে, একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে, আমি ঠাস করে দরজা খুললাম। ড্রয়ার খুলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। জোরে মোবাইল বাজিয়ে তিলাওয়াত শুনতে লাগলাম। আর এতে ওই বেচারার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমাদের একটু অনুভূতিও হল না যে, কত অশোভনীয় আচরণ করে ফেললাম! অথচ মহানবী (স.) ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যাবে এই আশঙ্কায় নিচু কণ্ঠে সালাম দিতেন জেগে থাকাদের। এজন্যে অপর ভাইয়ের কষ্ট হয়-এমন আচরণ মুমিন মুসলমানের জন্যে শোভনীয় নয়। আরবের এক কবি সুন্দর বলেছেন-

فإني رأيت الحب في الصدر و الأذى /  إذا اجتمعا لم يلبث الحب يذهب

 মনের মধ্যে ভালবাসা এবং কষ্ট যখন একত্র হয় তখন কষ্টটাই বাকি থাকে, ভালবাসা চলে যায়। ‘এমন কখনও হয় না যে, ভালবাসা থাকে, কষ্ট চলে যায়; বরং সবসময় ভালবাসাই চলে যায়।

নিজে যেমন আচরণ আশা করেন, ঠিক তেমন আচরণ যেন অন্যের সঙ্গে করা হয়, সেদিকে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ রাখার নির্দেশ এসেছে হাদিসে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (স.) ইরশাদ করেন-

فمن أحب أن يزحزح عن النار و يدخل الجنة فلتأته منيته وهو يؤمن بالله واليوم الآخر و ليأت إلى الناس الذي يحب أن يؤتى إليه.

  ‘যে চায় তাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করা হোক এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হোক, তার মৃত্যু তার কাছে আসুক আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রেখে, আর মানুষের সঙ্গে তেমন আচরণ করে, যেমন আচরণ সে নিজের জন্যে পছন্দ করে।’ (সহিহ মুসলিম)

কেয়ামতের দিন খুব ভারী ও মর্যাদাপূর্ণ আমল হবে সুন্দর আচরণ। হজরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন-

مَا مِنْ شَيْءٍ يُوضَعُ فِي الْمِيزَانِ أَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الْخُلُقِ وَإِنَّ صَاحِبَ حُسْنِ الْخُلُقِ لَيَبْلُغُ بِهِ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلَاةِ

‘কেয়ামতে দিন বান্দার সবচেয়ে ভারী ও মূল্যবান কর্ম হবে সুন্দর আচরণ। (শুধু তা-ই নয়) নিশ্চয়ই সুন্দর আচরণের অধিকারী মানুষ শুধু তার সুন্দর ব্যবহারের বিনিময়েই (নফল) নামাজ ও রোজা পালন করার সাওয়াব অর্জন করবে।’ (তিরমিজি, মাজমাউজ জাওয়াইদ)

রাসুল (স.) সবার সঙ্গে অত্যন্ত কোমল আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহ কোমলতা পছন্দ করেন। আল্লাহ কোমলতার বদলা হিসেবে যা দেন, কঠোরতার কারণে তা দেন না।’ (বুখারি: ২৫৯৩)

অপরের কল্যাণ প্রত্যাশা একজন মুসলিমের অন্যতম গুণ। পরামর্শ, উপদেশ, নির্দেশনাসহ অসংখ্য উপায়ে মানবসমাজের সব সদস্যের কল্যাণ কামনা করা যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘একজন মুসলিমের ওপর অন্য মুসলিমের ছয়টি অধিকার আছে।’ তখন বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, তা কী? তিনি বলেন—

‘মুসলিমের সঙ্গে তোমার দেখা হলে সালাম দেবে। তোমাকে ডাকলে সাড়া দেবে। তোমার কাছে পরামর্শ চাইলে উত্তম পরামর্শ দেবে। হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে তুমি তার উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলবে। অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে। আর মারা গেলে তার জানাজায় অংশগ্রহণ করবে।’ (মুসলিম: ২১৬২)

কারো মনে যেন ঘৃণা না জাগে-এই বিবেচনাবোধ থাকা একজন মুমিন মুসলমানের জন্যে বাঞ্ছনীয়। এটা সুন্দর আচরণের গুরুত্বপূর্ণ দিক। একবার আল্লাহর রাসুল (স.) জুমার খুতবা দিচ্ছিলেন। এক লোক সবার ঘাড় ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে সামনে আসছিল। আল্লাহর  রাসুল (স.) বললেন, ‘বসো! তুমি মানুষকে কষ্ট দিলে।’ ঘাড়ের উপর দিয়ে আসার মাধ্যমে কি শারীরিক কষ্ট হয়? হয় না। তবে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। এই বিরক্তিকর কাজ সম্পর্কেই বলছেন, فقد أذيت ‘তুমি কষ্ট দিলে’।

তাই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুমিন ওই ব্যক্তি যে অন্যদের ভালোবাসে এবং অন্যরাও তাকে ভালোবাসে। যে ব্যক্তি অন্যদের ভালোবাসে না এবং অন্যরাও তাকে ভালোবাসে না তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।’ (জামে)

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন, যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্যে মাগফেরাত কামনা করুন।’ (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)

কোরআনুল কারিমে আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, এতিম, দরিদ্র, প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথিক এবং যারা তোমাদের অধিকারে এসেছে, সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো’ (সুরা আন নিসা:৩৬)। হাদিসে এসেছে—

‘যে ব্যক্তি সুন্দর আচরণ থেকে বঞ্চিত সে কল্যাণ থেকেও সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত।’ (সহিহ মুসলিম)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পরস্পরের সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম আচরণ করার তাওফিক দান করুন। কোরআন ও সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। প্রিয়নবীর প্রিয়পাত্র হিসেবে নিজেদেরে গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর