বিয়ে আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত ও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। চারিত্রিক অবক্ষয় রোধ, আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদাপূরণ ও মানবিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ বিয়ে। এটি ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো— তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম: ২১)
প্রশ্নে উল্লেখিত কাবিন মানে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন। এই রেজিস্ট্রেশনের ফলে বিয়ের সব তথ্য সরকারের তথ্যভাণ্ডারে নথিভুক্ত হয়। নিয়ম হলো— বিয়ের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে রেজিস্টার বা কাজি বিয়ের নিবন্ধন করবেন। বর ও কনে বিবাহ-নিবন্ধন বইয়ে স্বাক্ষর করবেন।
বিজ্ঞাপন
এই নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশনের কারণে দুই পক্ষই বিশেষ করে নারীরা আইনগত সব সুরক্ষাসহ তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন। স্ত্রী প্রতারণার শিকার হলে এই রেজিস্ট্রেশনের সনদ রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। স্বামীর মৃত্যু-পরবর্তীকালে স্বামীর সম্পত্তির বৈধ অংশসহ অন্যান্য দাবি আদায়ে এই দলিলটি অত্যাবশ্যক। এমনকি তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের সময়ও বিবাহের রেজিস্ট্রেশন একটি অত্যাবশ্যকীয় দলিল।
তবে, কাবিন বিয়ের কোনো অংশ নয়। ইসলামে বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য চারটি শর্ত ও দুইটি রুকন সম্পাদন হওয়া জরুরি। রুকন দুটি হলো- ১. ইজাব বা প্রস্তাব ২. কবুল বা প্রস্তাবগ্রহণ (সুরা নিসা: ১৯) চারটি শর্ত—১. পরস্পর বিয়ে বৈধ এমন পাত্র-পাত্রী নির্বাচন (সুরা নিসা: ২৩-২৪) ২. উভয়ের সম্মতি (বুখারি, মুসলিম, মেশকাত: ৩১২৬)। ৩. মেয়ের ওলী বা অভিভাবক থাকা (আহমদ, তিরমিজি; মেশকাত: ৩১৩০), ৪. দুজন ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষী থাকা (তাবারানি, সহিহুল জামে: ৭৫৫৮)
অতএব বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য বর-কনে বা তাদের প্রতিনিধির ইজাব-কবুল তথা ‘বিবাহ দিলাম’ ও ‘কবুল করলাম’—এই জাতীয় সুস্পষ্ট মৌখিক ঘোষণা সাক্ষীদের সামনে একই মজলিসে হওয়া আবশ্যক। শুধুমাত্র কাবিননামার ঘর পূরণ করে দস্তখত নেওয়া বা তা পাঠ করে শোনানোর মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হবে না। (সূত্র- রদ্দুল মুহতার: ৩/১২, বাহরুর রায়েক: ৩/৮৯; ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৬/৮৪)
ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো- কাবিনের আগে বিয়ে করতে হবে। বিয়েই যদি সম্পাদিত না হয়ে থাকে, তাহলে নিবন্ধন কিসের হবে?
বিজ্ঞাপন
আমাদের সমাজে প্রায়ই শোনা যায়, ‘কাবিন করে রেখেছি, বিয়ে কয়েক মাস পরে হবে।’ অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি কাজি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাগাদা দিতে থাকে যে ‘কাবিনের কাজ শেষ করে ফেলুন। আমার জরুরি কাজ আছে। আমি চলে যাই। পরে আপনারা মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে নেবেন।’ এসব অনুচিত।
রেজিস্ট্রেশনে কত তারিখে বিয়ে সম্পাদিত হলো, কোথায় বিয়ে পড়ানো হলো, বিয়ে কে পড়িয়েছেন—এসব উল্লেখ থাকে। আপনি যখন বিয়ে পড়ানো ছাড়াই শুধু কাবিন করে রাখছেন তখন আপনাকে নিবন্ধন ফরমের উপরোক্ত কলামগুলোতে মিথ্যা তথ্য লিখতে হচ্ছে। কেননা, বিয়ে হয়নি তাই বিয়ে সম্পাদনের তারিখ, স্থান আপনি কোথায় পাবেন? এককথায়, বিয়ের আগে কাবিন করার দ্বারা বিয়ের পাত্র, পাত্রী, সাক্ষী, সনাক্তকারী, সরকারি নিবন্ধক কিংবা কাজী সবাই মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। এসব গুনাহের কাজ পরিত্যাগ করা জরুরি।
মিথ্যা লেখা ছাড়াও বিয়ের আগে কাবিন করার জটিলতর সমস্যা রয়েছে। নিবন্ধন ফরমের একটি কলামে আছে, বর কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকে তাফবিজের ক্ষমতা প্রদান করা হলো কি না? হলে তা কী কী শর্তে? ফরমের এ কলাম পূরণকালে সাধারণত ‘হ্যাঁ’ লিখে তিনটি শর্ত উল্লেখ করা হয়। এর অর্থ হলো- স্বামী তার স্ত্রীকে শর্ত স্বাপেক্ষে তালাকে তাফবিজ গ্রহণের ক্ষমতা দিল। দেখুন, স্বামী তার স্ত্রীকে বিয়ের আগেই তালাকে তাফবিজ গ্রহণের ক্ষমতা দিয়ে দিচ্ছে। অথচ বিয়ের আগে পুরুষ নিজেরই তালাক দেওয়ার অধিকার নেই। কারণ তালাকের অধিকার পাওয়ার জন্য বিয়ে করা শর্ত। যে নিজেই তালাক দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না সে কিভাবে কনেকে তালাকের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়? সুতরাং বিয়ের আগে কাবিন করাকে আলেমরা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য বলে থাকেন।
অতএব, ইসলামি শরিয়ত মতে বিয়ে পড়ানোর কাজ সুসম্পন্ন হওয়ার পরেই কেবল সরকারি নিয়ম মতে কাবিন করতে হবে। বিয়ের আগে কাবিন নয়। এমনকি বিয়ে পড়ানোর পাঁচ মিনিট পূর্বেও কাবিন নয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধান সম্পর্কে সবকিছু জানার ও যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

