রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

১১৫ টাকা দিলেই কি ফিতরার হক আদায় হবে?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

১১৫ টাকা দিলেই কি ফিতরার হক আদায় হবে?

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত এক ইবাদত ‘সদকাতুল ফিতর’। হাদিস শরিফে সদকাতুল ফিতরকে কাফফারাতুন লিসসাওম—অর্থাৎ ‘রোজা অবস্থায় অবচেতনভাবে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, তার ক্ষতিপূরণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, সদকাতুল ফিতরের কারণে গরিব মানুষ সুন্দরভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারে, এজন্যই সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। এটি সঠিক বক্তব্য নয়। বরং শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, সদকাতুল ফিতরের মাধ্যমে মূলত রোজা অবস্থায় অজ্ঞাতসারে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি (চোখের ভুল, কানের ভুল, কথার ভুল, হাত-পায়ের ভুল ইত্যাদি) হয়, তার ক্ষতিপূরণ হয়। যদিও শরিয়তের এই হুকুমে গরিবেরও উপকার হয়, তবে এটি ফিতরার অন্তর্নিহিত অর্থ নয়।

সদকাতুল ফিতর কখন আদায় করতে হয়
ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। জাকাতের মতো রমজান মাসের যেকোনো সময়েও আদায় করা যায়। তবে কোনো অবস্থায়ই ঈদের জামাতের পরে দেওয়া যাবে না। পরে দিলে সেটা সাধারণ দান-সদকা হয়ে যাবে; সদকাতুল ফিতর হবে না। তাই ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ঈদের নামাজ আদায়ের পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিতেন।’ (সহি বুখারি: ১৫০৩, ১৫০৯)


বিজ্ঞাপন


ফিতরা দেওয়ার সময় শুরু হয় রমজানের শেষ দিনে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে। (সউদি ফতোয়া কমিটি: ৯/৩৭৩)

অবশ্য কোনো কোনো সাহাবি থেকে ঈদের কয়েকদিন পূর্বেও ফিতরা আদায়ের কথা প্রমাণিত আছে। যেমন নাফে (রাহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দুয়েকদিন পূর্বেই তা (ফিতরা) আদায় করে দিতেন। (বুখারি: ১৫১১; আবু দাউদ: ১৬০৬) আর নাফে (রাহ.) থেকে অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দুই তিনদিন পূর্বে ফিতরা উসূলকারীর নিকট সদকাতুল ফিতর পাঠিয়ে দিতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক: ৩১৬)

এর ভিত্তিতে আলেমরা বলেন, সদকাতুল ফিতর রমজানের শেষ দিকেই আদায় করা উচিত। এতে গরীব লোকদের জন্য ঈদের সময়ের প্রয়োজন পূরণেও সহায়তা হয়। আর রমজানের শুরুতে বা পূর্বে ফিতরা আদায় করলেও অধিকাংশ ফকিহগণের মতে তা আদায় হয়ে যায়। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৫৫; খানিয়া: ১/২৩২; বাদায়েউস সানায়ে: ২/২০৭; রদ্দুল মুহতার: ২/৩৬৭; আলমুহিতুল বুরহানি: ৩/৩৮৪; তাবয়িনুল হাকায়েক: ২/১৪২)

সদকাতুল ফিতর কার ওপর ওয়াজিব
ইসলামি শরিয়তে ‘ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন ও নারী-পুরুষ সবার ওপরই এটি ওয়াজিব’ (সহিহ বুখারি: ১৫১২)। এমনকি পবিত্র রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফতোয়া আলমগিরি: ১/১৯২)


বিজ্ঞাপন


সদকাতুল ফিতরের নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় কারো কাছে বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল ক্বাদির: ২/২৮১)

খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
পাঁচ ধরণের খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। খেজুর, পনির, জব, কিসমিস এবং গম। সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ সম্পর্কে শরিয়তে দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ‘এক সা’ বা ‘অর্ধ সা’। ১) খেজুর, পনির, জব ও কিশমিশ দ্বারা আদায়ের ক্ষেত্রে এক ‘সা’=৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)—অর্থাৎ তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। ২) গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে ‘নিসফে সা’=১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম, অর্থাৎ এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি প্রযোজ্য হবে। (আওজানে শরইয়্যাহ, পৃ. ১৮)

দুটির যে কোনো একটিকে পরিমাপ ধরে আদায় করলে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে। অবশ্য যিনি সামর্থ্য অনুযায়ী যত বেশি আদায় করবেন তিনি তত বেশি ছওয়াবের অধিকারী হবেন।  

এবারের সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ 
(১) গম/আটা: পরিমাপ অর্ধ সা। কেজির হিসাবে প্রায় ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম। তবে ন্যূনতম পূর্ণ ২ সের/কেজির মূল্য আদায় করা উত্তম ৷ যার বর্তমান বাজার মূল্য ১১৫ টাকা। (২) যব: যবের পরিমাপ এক সা। কেজির হিসাবে প্রায় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩৯৬ টাকা। (৩) কিসমিস: এর পরিমাপও এক সা। কেজির হিসাবে প্রায় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ হাজার ৬৫০ টাকা। (৪) খেজুর: এর পরিমাপ এক সা। কেজির হিসাবে প্রায় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ হাজার ৬৫০ টাকা। (৫) পনির: পনিরের পরিমাপও এক সা। কেজির হিসাবে প্রায় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২ হাজার ৬৪০ টাকা। সূত্র: ইসলামিক ফাউন্ডেশন

সর্বোচ্চ দামের ফিতরা আদায় করা সুন্নত
প্রত্যেকে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করা যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ দামেরটা দেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায়, যাদের খেজুরের মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ্য আছে, তারাও সর্বনিম্ন গমের মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করে। এমনভাবে যাদের কিসমিসের মূল্য দিয়ে আদায় করার সামর্থ্য আছে, তারাও গমের মূল্য দিয়ে আদায় করে। এটি সঠিক পদ্ধতি নয়। নবী কারিম (স.)-কে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন- أغلاها ثمنا وأنفسها عند أهلها ‘দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি’। (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ইতক ৩/১৮৮; সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান: ১/৬৯)

সুতরাং, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসেবে সদকাতুল ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে, সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসেবে দেওয়ার, সে তাই দেবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসেব গ্রহণ করতে পারে। আর যার জন্য এগুলোর হিসেবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিই উত্তম নিয়ম। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরীবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা। সাহাবায়ে কেরাম আধা সা গম দিয়ে সদকা আদায় করার কারণ ছিল, আধা সা গমের মূল্য তখন এক সা খেজুরের সমান ছিল।

হজরত মুআবিয়া (রা.) এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ‘সা’ গমকে সদকাতুল ফিতরের অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের এক ‘সা’র মতো গণ্য করা হত। ( আল ইসতিযকার: ৯/৩৫৫)

তাই মুমিন মুসলমানের উচিত, শুধু গমের মূল্য দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় না করে সামর্থ্য অনুযায়ী খেজুর, পনির এবং কিসমিসের মুল্য দিয়েও সদকাতুল ফিতর আদায় করা। 

সদকাতুল ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা যায়
সদকাতুল ফিতর খাদ্যদ্রব্য দিয়ে যেমন আদায় করা যায়, তেমনি টাকা দিয়েও আদায় করা যায়। ইমাম বুখারি (রহ.) তাঁর সহিহ বুখারিতে মুআজ (রা.)-এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি ইয়ামেনবাসীকে বলেন, তোমরা সদকার মধ্যে খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে কাপড় নিয়ে আসো। কেননা এটা তোমাদের জন্য অধিকতর সহজ এবং মদিনার সাহাবিগণের জন্যও অধিক উপযোগী। (বুখারি: ১১৪৭)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেছেন, টাকা দিয়ে আদায় করা উত্তম। কারণ এটি মানুষের জন্য সহজ এবং উপকারী। আল্লামা ইবনু রাশিদ (রহ.) বলেন, উক্ত মাসয়ালাটির মাঝে ইমাম বুখারি (রহ.) হানাফিদের সহমত পোষণ করেছেন। (ফাতহুল বারি, ইবনে হাজার: ৩/৩১২)

জুহাইর (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু ইসহাক (রহ.) থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন, আমি সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-কে এই অবস্থায় পেয়েছি যে তারা রমজানে সদকাতুল ফিতর খাবারের বিনিময়ে টাকা দ্বারা আদায় করতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১০৪৭২) হাসান বসরি (রহ.) বলেন, টাকা দ্বারা সাদাকায়ে ফিতর আদায় করাতে কোনো সমস্যা নেই। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১০৪৭১)

বিখ্যাত ইমাম ইবনে আবি শায়বা তার রচিত কিতাব ইবনে আবি শায়বা-২/৩৯৮-এর মাঝে এভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে অর্থাৎ ‘সাদকাতুল ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার (বৈধতা) সম্পর্কে।’ ইমাম বায়হাকি (রহ.) তার রচিত কিতাবু সুনানুল কুবরা-৪/১৮৯-এর মাঝে এভাবে অনুচ্ছেদ স্থাপন করেন যে অর্থাৎ ‘এই অনুচ্ছেদ হলো টাকা দ্বারা জাকাত আদায় করা অনুমোদিত।’ মোটকথা সালাফদের কর্ম ও বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট যে টাকা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়; বরং ক্ষেত্রবিশেষ এর মাধ্যমে আদায় করা উত্তম।

এক ফিতরা কয়েকজনকে বা কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেওয়া যায়
সদকাতুল ফিতর ১০ জনেরটা একজনকে দেওয়া যাবে, একজনেরটা কয়েকজনকে ভাগ করেও দেওয়া যাবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। এখানে মূলকথা হচ্ছে- আপনার অধীনস্থ সবার সদকাতুল ফিতর আদায় হচ্ছে কি না, সেটাই বিবেচ্য। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে সঠিকভাবে সদকাতুল ফিতর আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর