রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইসলামে বিয়ের যোগ্যতা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:২৩ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসলামে বিয়ের যোগ্যতা

বিয়ে আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত এবং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। প্রথম মানব-মানবী হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর বিয়ের মাধ্যমে এই পবিত্র বন্ধনরীতির প্রচলন হয়। বিয়ে চরিত্র রক্ষার হাতিয়ার। তাই সক্ষমতা থাকলে দ্রুত বিয়ে করা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—‘হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিবাহ করে নেয়। কারণ, বিবাহ চক্ষুকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।’ (বুখারি: ৫০৬৬; মুসলিম: ১৪০০)

বিয়ের বয়স ও যোগ্যতা
ইসলাম বাল্যবিয়েকে নিরুৎসাহ করলেও বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করেনি; বরং শারীরিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে সক্ষমতা অর্জনকেই বিয়ের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে। অঞ্চলভেদে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী বিয়ের সমীচীন বয়সসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে বিশেষ অবস্থায় এ বয়সসীমা শিথিলও হতে পারে। যেমন—কোনো ব্যক্তির যৌনসংক্রান্ত অনাচারে লিপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলে এবং অন্য সামর্থ্য অর্জিত হলে তার বিয়েতে বাধা দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কোনোভাবে সমীচীন নয়। এভাবে কোনো নারী শারীরিক, মানসিকভাবে পূর্ণতা লাভ করার পর সুযোগ্য পাত্র পাওয়া গেলে তার অভিভাবকদের দ্রুত বিয়ের আয়োজন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যখন এমন কোনো ব্যক্তি তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে, যার দ্বীনদারি ও চারিত্রিক দিক তোমাদের মুগ্ধ করে, তখন তোমরা ওই ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দাও। যদি তোমরা তা না করো তাহলে সমাজে বিরাট ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় দেখা দেবে।’ (তিরমিজি: ১০৮৪)


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: গোপনে বিয়ে করা ইসলামে অপছন্দনীয়

বিয়ে দ্বীনের অর্ধেক
বিয়ের মাধ্যমে দ্বীনের অর্ধেক পূরণ হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন বান্দা বিয়ে করে, তখন সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করে। অতএব, বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’ (সহিহ আল-জামিউস সাগির ওয়া জিয়াদাতুহু: ৬১৪৮; তাবারানি: ৯৭২; মুসতাদরাক হাকিম: ২৭২৮)। রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ যাকে পুণ্যময়ী স্ত্রী দান করেছেন, তাকে তার অর্ধেক দ্বীনে সাহায্য করেছেন। সুতরাং বাকি অর্ধেকের ব্যাপারে তার আল্লাহকে ভয় করা উচিত।’ (তাবারানির আওসাত: ৯৭২; সহিহ তারগিব ওয়াত তারহিব: ১৯১৬)

নবী-রাসুলদের সুন্নত
ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে শুধু একটি উৎসাহিত বিষয়ই নয়; বরং নবী-রাসুলদের সুন্নত। ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.) ছাড়া সব নবী-রাসুল বিয়ে করেছেন। আবু আইয়ুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘চারটি জিনিস নবী-রাসুলদের সুন্নত। লজ্জাবোধ, সুগন্ধি ব্যবহার, মেসওয়াক ও বিয়ে।’ (তিরমিজি: ১০৮০)

আল্লাহর অনুগ্রহ ও সচ্ছলতার উপায়
বিয়ে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার মাধ্যম। এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহর ওপর ভরসা ও নিজের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার সদিচ্ছা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ছেলেদের স্ত্রী নেই এবং যে মেয়েদের স্বামী নেই তাদের এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদের বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তারা অভাবগ্রস্ত থাকে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের ধনী করে দেবেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর: ৩২)
আরও ইরশাদ হয়েছে ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম: ২১)


বিজ্ঞাপন


শান্তি ও সুশৃঙ্খল জীবনের মাধ্যম
বিয়ে মানসিক প্রশান্তি, স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল জীবনের অন্যতম মাধ্যম। বিয়ের মাধ্যমে দুটি পরিবারের পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে সুন্দর পৃথিবী গড়ে ওঠে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য তাতে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে।’ (সুরা রুম: ২১)

আরও পড়ুন: বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করা জায়েজ?

ক্যারিয়ারের অজুহাতে বিয়ে করতে দেরি নয়
ইসলামে বিয়ের ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেওয়ার পরও অনেকে অর্থ-সংকটের কথিত অজুহাতে কিংবা ক্যারিয়ারের চিন্তায় বিয়ে করতে বা করাতে গড়িমসি করেন। অথচ তাদের এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা শরিয়তের আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা মানুষের আয়-রোজগার স্থায়ী বিষয় নয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছে—‘তিন প্রকারের মানুষকে সাহায্য করা আল্লাহ তাআলা নিজের কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। ১. আল্লাহ তাআলার পথে জিহাদকারী। ২. মুকাতাব গোলাম- যে চুক্তির অর্থ পরিশোধের ইচ্ছা করে। ৩. বিয়ে করতে আগ্রহী, যে পবিত্র জীবন যাপন করতে চায়। (ইবনে মাজাহ: ২৫১৮)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিয়ে করিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়েতে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে, যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন। (সুরা নুর: ৩২-৩৩)

স্বামী-স্ত্রী পরস্পর পোশাকের মতো
রোদ, বৃষ্টি, ঠাণ্ডা থেকে রেহাই পেতে এবং সৌন্দর্য বর্ধন করতে যেমন পোশাকের প্রয়োজন। বিয়েও ঠিক তেমনই, দুইজন মানুষকে এমনভাবে এক করে, তারা একে অপরের পোশাক এর মতো হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা (স্বামীগণ) তাদের পোশাকস্বরূপ`। (সুরা বাকারা: ১৮৭)

আরও পড়ুন: অবৈধ সম্পর্ক থাকাবস্থায় ইবাদত কবুল হবে?

বরকতময় বিয়ে
সর্বোত্তম, কল্যাণকর ও বরকতময় বিয়ে হলো, যা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সহজসাধ্যভাবে অল্প খরচে অনুষ্ঠিত হয়। জমকালো আয়োজন, জৌলুসপূর্ণ আলোকসজ্জা, গান-বাদ্য এবং খরচের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিয়ের বরকত নষ্ট করে। ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘সর্বোত্তম  বিয়ে হলো যা খরচের দিক থেকে সহজসাধ্য হয়।’ (আবু দাউদ: ২১৯)

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ধার্মিকতা অগ্রাধিকার পাবে
বিয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হওয়া উচিত ধার্মিকতা। একজন ধার্মিক ব্যক্তিই নৈতিকতা, দায়িত্বসচেতনতা, কর্তব্যবোধ, কল্যাণকামিতা, অল্পে তুষ্টি, পরকালকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী। এজন্য বিয়ের ক্ষেত্রে রাসুল (স.) ধার্মিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ‘চারটি গুণ দেখে মেয়েদের বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ, বংশ, সৌন্দর্য এবং ধার্মিকতা। তোমরা ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দাও।’ (বুখারি: ৪৮০২)

সৎ নিয়তেও অবিবাহিত থাকা যাবে না
বিয়ে না করা আল্লাহর রাসুলের পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের সঙ্গে বেয়াদবির শামিল। এমনকি সওয়াবের নিয়তেও যদি হয়। হাদিসে ওসব ব্যক্তিদেরকে কঠিন হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তি আল্লাহ রাসুল (স.)-এর ঘরে আসলেন। তারা ঘরবাসীদের রাসুল (স.)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তাঁর ইবাদতের কথা শুনে তারা যেন বলল, কোথায় আল্লাহ রাসুল (স.) আর কোথায় আমরা? তার আগের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।

তখন তাদের একজন বলল, আমি সারাজীবন রাতভর ইবাদত করব। আরেকজন বলল, আমি আজীবন রোজা রাখব; কখনো রোজা ভাঙব না। অন্যজন বলল, আমি নারীদের থেকে দূরে থাকব; কখনো বিয়ে করব না। আল্লাহর রাসুল (স.) তখন তাদের কাছে এসে বললেন, ‘আরে! তোমরা এমন-অমন বলছো না! অথচ আমি তোমাদের সবার চেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি। কিন্তু আমি রোজা রাখি, আবার ইফতারও করি। নামাজ পড়ি, আবার ঘুমাই। বিয়েও করি। অতএব, যারা আমার সুন্নত ছেড়ে দেবে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি: ৫০৬৩; মুসলিম: ১৪০১)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর যুবকদের সুন্নাহ অনুযায়ী যথাসময়ে বিয়ে করার তাওফিক দান করুন। অভিভাবকদেরকে সুন্নতচর্চায় সন্তানের সহযোগী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর