প্রসিদ্ধ সাহাবি আবু হুরায়রা আদ-দাউসি (রা.)। পূর্ব নাম আবদু শামস। ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসুল (স.) তাঁর নাম রাখেন আবদুল্লাহ বা আবদুর রহমান। ‘আবু হুরায়রা’ উপনামেই তিনি প্রসিদ্ধ। তিনি ‘দাউস’ গোত্রের সন্তান। (আল ইসাবাহ: ৭/৩৪৮-৩৪৯)
‘আবু হুরায়রা’ নামে পরিচিতির কারণ
ইমাম তিরমিজি (রহ.) আব্দুল্লাহ ইবনে রাফে (রহ.) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ‘আবু হুরায়রা’ উপনামে কেন ভূষিত হলেন? তদুত্তরে তিনি বললেন, (ছোটবেলায়) আমি আমাদের ছাগল চরাতাম। বিড়ালের একটি বাচ্চা ছিল আমার। আমি তাকে রাতের বেলা গাছের ওপর ছেড়ে দিতাম। আর দিনের বেলা সঙ্গে রাখতাম; তাকে নিয়ে খেলা করতাম। লোকজন তা দেখে আমাকে ‘আবু হুরায়রা’ ডাকতে শুরু করল। (একসময় এতেই আমি প্রসিদ্ধ হয়ে গেলাম।) (তিরমিজি: ৩৮৪০)
বিজ্ঞাপন
অপর বর্ণনামতে ইসলামগ্রহণের পর একবার তিনি বিড়ালের একটি বাচ্চা জামার হাতার মধ্যে রাখলেন। রাসুল (স.) তা দেখে বলেন, তুমি ‘আবু হুরায়রা’ (বিড়াল-ওয়ালা)। এরপর তিনি এ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান। (আল-ইসাবাহ: ৭/৩৪৮- ৩৪৯)
মহানবী (স.)-এর সাহচর্যে ইলম অর্জন
আবু হুরায়রা (রা.) প্রসিদ্ধ সাহাবি তুফাইল ইবনে আমর আদ-দাউসি (রা.)-এর দাওয়াতে ইসলামগ্রহণ করেন। ইসলামগ্রহণের পর তিনি নিজ গোত্রে অবস্থান করেন। এরপর সপ্তম হিজরির শুরুর দিকে স্বগোত্রের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মদিনায় আসেন। তখন রাসুল (স.) খাইবারে। সেখানে গিয়ে রাসুল (স.)-এর খেদমতে উপস্থিত হন। যুদ্ধশেষে রাসুল (স.)-এর সঙ্গে ফিরে আসেন মদিনায়। (আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা: ৪/২৪৪, ১৮১পৃ., ক্র.৫২০, ৪৩৩)
নবীজির সান্নিধ্যে থাকতে উপার্জনের পথ খুঁজেননি
মদিনায় আসার পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে রাসুল (স.)-এর সাহচর্যে ও খেদমতে লেগে থাকেন এবং তাঁর তালিম ও তারবিয়তে নিজেকে গড়তে থাকেন। তিনি ছিলেন মসজিদের পাশে অবস্থিত ‘সুফফা’ মাদরাসার অন্যতম ছাত্র, যেখানে খাবারের ব্যবস্থা হলে খেতেন, অন্যথায় উপোস থাকতেন। যেহেতু তিনি সবসময় নবীজির দরবারেই পড়ে থাকতেন, নবী (স.) যখন যা-ই বলতেন মুখস্থ করে নিতেন, ফলে আয়-উপার্জনের কোনো সুযোগও ছিল না তাঁর। ক্ষুধা-পিপাসাকে সঙ্গী করেই চলতে হত তাঁকে।
রাসুল (স.) যে খাদ্য হাদিয়া পেতেন, প্রায় সময়ই তা আসহাবে সুফফার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। আবু হুরায়রার ভাগে যতটুকু পড়তো, অপর্যাপ্ত হলেও তা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। সাহাবিরা তাঁকে কখনও ক্ষুধায় কাতর দেখলে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে আহার করাতেন। একদা জাফর ইবনে আবু তালিব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যান; কিন্তু ঘরে কিছু না থাকায় ঘি’এর শূন্য পাত্রটি হাজির করলেন। আবু হোরায়রা তা-ই চেটে ক্ষুধা বৃত্তির প্রয়াস পেলেন। অনেক সময় খেজুর আর পানি খেয়েই তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। কখনও কখনও পেটে পাথর বেঁধে শুয়ে থাকতেন; কিন্তু কোনো দিন কারো নিকট কিছু চাইতেন না।
বিজ্ঞাপন
একবার তিনি মসজিদের দিকে রওনা হলেন। মসজিদে নববির সামনে দেখলেন- কিছু লোক জটলা বেঁধে আছে। এগিয়ে গেলেন তিনি। তারা দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন- আবু হুরায়রা! কী জন্য এলে এখানে? তিনি বললেন, ক্ষুধায় আর টিকতে পারছি না, বের হলাম- দেখি কী হয়! তারা বলল- হায় আল্লাহ! আমরাও তো ক্ষুধার কারণেই এখানে সমবেত হয়েছি। রহমতের নবী ঘর থেকে বেরিয়ে জানতে চাইলেন—এ মুহূর্তে তোমরা এখানে! তখন তারা তাদের অবস্থার কথা জানালো। তখন নবীজি তাদের প্রত্যেককে দুটি করে খেজুর তুলে দিলেন এবং বললেন, খেজুর দুটো খেয়ে পানি পান করে নিও, আজ আর সারাদিন তোমাদের ক্ষুধা লাগবে না। আবু হুরায়রাও দুটো খেজুর নিলেন। কিন্তু খেলেন মাত্র একটি। অপরটি রেখে দিলেন। নবীজি দেখে ফেললেন- ‘আবু হুরায়রা! আরেকটা তুলে রাখছ কী জন্যে?’ তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! বাড়িতে মা আছেন, এটি তাকে দেবো। ‘না, না দুটোই তুমি খেয়ে নাও। তোমাকে আরও দুটো দিচ্ছি। মা’কে নিয়ে দেবে।’ (তবাকাতে ইবনে সা‘দ: ৪/৩২৮; তারিখে ইবনে আসাকির: ৫৮/৪৪০)
এই হচ্ছে আবু হুরায়রার ক্ষুধাকাতর জীবন। এরকম অবস্থায়ও তিনি নবীজির সঙ্গ ছাড়েননি। খাবারের ফিকির করতে গেলে রাসুল (স.)-এর তালিম থেকে অনুপস্থিত থাকতে হবে—সে কথা ভেবে খাবার নিয়ে কোনো চিন্তাও করতেন না।
স্মৃতিশক্তি ও হাদিস বর্ণনা
একদা তিনি রাসুল (স.)-এর কাছে এ মর্মে অভিযোগ করলেন যে হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনার থেকে অনেক হাদিস শুনেছি, তবে তা ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করলেন, তোমার চাদর বিছাও। তিনি বিছালেন। অতঃপর রাসুল (স.) চাদরে হাত বুলিয়ে দিয়ে তা বুকে জড়িয়ে নিতে বললেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমি তা বুকে জড়িয়ে নিলাম। এরপর থেকে আমি কোনো কিছু ভুলিনি। ইমাম বুখারি (রহ.) বলেন, আট শরও বেশি সাহাবি ও তাবেঈন তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। (আত-তাবাকাতুল কুবরা: ৪/২৪৫, ২৪৬)
সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে ৫৩৭৪টি হাদিস বর্ণিত আছে। ইবনে কাসির (রহ.) ইমাম বুখারি (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি ও তাবেঈনদের সংখ্যা ৮০০ থেকেও বেশি। তাঁর শিষ্যদের তালিকায় হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ (রহ.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১০৩)
সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী হলেও অনেক হাদিস তিনি প্রকাশ করেননি। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (স.)-এর নিকট থেকে দুটি পাত্র (জ্ঞান) সংরক্ষণ করেছি। যার একটি আমি প্রচার করে দিয়েছি। কিন্তু দ্বিতীয়টি যদি প্রচার করতাম, তাহলে আমার এই কণ্ঠনালী কাটা যেত।’ (বুখারি: ১২০; মেশকাত: ২৭১)
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরামগণ বলেন, সে পাত্রে নিকৃষ্ট নেতাদের নাম, অবস্থা ও সময়কাল স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। অবশ্য আবু হুরায়রা (রা.) কোনো কোনো সময় তাদের উপনাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু জীবনের ভয়ে স্পষ্ট করে নাম উল্লেখ করেননি। যেমন একটি উদাহরণ হলো— তিনি দোয়ায় বলতেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ষাট হিজরি থেকে আশ্রয় চাই। বালকদের নেতৃত্ব থেকে আশ্রয় চাই। এর দ্বারা তিনি ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার খেলাফতের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। কারণ তিনি ষাট হিজরিতে খেলাফত লাভ করেন। আল্লাহ তাআলা আবু হুরায়রা (রা.)-এর দোয়া কবুল করেন। তিনি ঊনষাট হিজরিতে মারা যান। (ফাতহুল বারি: ১/২১৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিখ্যাত এই জ্ঞানসাধক সাহাবির জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

