মেরাজ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মোজেজা। শবে মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমনের রাত। রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা, এরপর বোরাকে করে ঊর্ধ্বাকাশ পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করার নামই মেরাজ। বাংলাদেশে ১৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার দিবাগত রাতে পবিত্র শবে মেরাজ পালিত হবে।
এই রাত উম্মতে মুহাম্মদির জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঊর্ধ্বভ্রমণের আগে মহানবী (স.) সব নবীকে নিয়ে নামাজের ইমামতি করেন। এরপর বিশেষ বাহন বোরাকে আরোহন করেন। এই যাত্রাপথে সাত আসমানে সাতজন বিশিষ্ট নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নবীজির। এরপর সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে সবুজ রঙের বাহন রফরফে করে আরশে আজিমে পৌঁছে তিনি আল্লাহর দিদার লাভে ধন্য হন। নামাজের বিধান রচিত হয় এ রাতেই।
বিজ্ঞাপন
মেরাজ কোরআন-হাদিস ও ইজমায়ে উম্মত-এর অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে, এ ঘটনার পর রাসুল (স.) অনেক বছর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শবে মেরাজকেন্দ্রিক কোনো আমলের ব্যাপারে বিশেষ হুকুম দেননি। রাসুলুল্লাহ (স.) নিজেও বিশেষ আমল করেননি। রাসুল (স.)-এর পর ১০০ বছর সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তাঁরা ২৭ রজবকে বিশেষভাবে উদযাপন করেছেন বলে একটি ঘটনাও পাওয়া যায়নি। যে কাজ রাসুল (স.) করেননি, সে কাজ সাহাবায়ে কেরামও পরিহার করেছেন। সুতরাং ২৭ রজবে কোনো আমলকে দ্বীনের অংশ মনে করা, সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হাদিস ও সুন্নতসম্মত নয়।
বরং অনর্থক কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখে মেরাজের আসল তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া নামাজ সঠিক সময়ে আদায় করতে হবে। এছাড়াও শিরক না করা, পিতা-মাতার অবাধ্য আচরণ না করা, এতিমের মাল আত্মসাৎ করা থেকে বিরত থাকা, সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা, খাদ্যাভাবে সন্তানকে হত্যা না করা, অহংকার ও অনুমাননির্ভর কাজ থেকে বিরত থাকা, জেনা-ব্যভিচারের ধারেকাছেও না যাওয়া, প্রতিবেশীর হক আদায় করাসহ ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষা আমরা মেরাজের ঘটনা থেকে পাই।
অনেকে আশুরা ও আরাফার রোজার মতো ২৭ রজব তারিখে রোজা রাখাকে সুন্নত ও ফজিলতপূর্ণ আমল মনে করেন। এটি সঠিক নয়। এ ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই। দ্বীনের সব কিছু আল্লাহর অনুসরণ-অনুকরণ ও আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই দিনকে বেশি ফজিলতপূর্ণ মনে করে, সুন্নত মনে করে, মুস্তাহাব ও অধিক সওয়াবের উপায় মনে করে রোজা রাখা এবং রাত জাগা কোনোটিই ঠিক নয়; বরং বিদআত।
আজকাল ফরজ-ওয়াজিবের মতো যে জিনিসটি ছড়িয়ে পড়েছে, তাহলো শিরনির আয়োজন। শিরনি না করলে যেন মুসলমানই নয়। নামাজ পড়ুক না পড়ুক, রোজা রাখুক বা না রাখুক, গুনাহ পরিত্যাগ করুক বা না করুক শিরনি কিন্তু করতেই হবে। কেউ যদি শিরনি না করে অথবা শিরনি করতে বাধা দেয় তাকে সব ধরনের নিন্দা করা হয়। অথচ এই প্রথা কোরআন হাদিসে, সাহাবায়ে কেরাম-তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন কিংবা কোনো বুজুর্গ—কারো জীবনেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়টি যারা না জেনে কুসংস্কারে হারিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে বিনয় ও ভদ্রতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে বোঝাতে হবে।
তবে অন্যান্য দিনের মতো এ রাতেও নফল ইবাদত করতে কোনো বাধা নেই। ২৬ তারিখ রাত জেগে ইবাদত করেছেন, ২৭ তারিখেও রাত জাগতে অসুবিধা নেই। তেমনিভাবে ২৭ তারিখের পরও রাত জাগুন। আবার পুরো রজব মাসটিই আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাস থেকে মহানবী (স.) রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, তা আমরা নবীজি (স.)-এর আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে পারতাম।’ নফল নামাজ-রোজা যেকোনো রাতে করতে নিষেধ নেই, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই এ রাতের নির্দিষ্ট কোনো আমলের কথা না বলা হলেও কেউ আল্লাহপ্রেমে রাতের নামাজ-তেলাওয়াতে মশগুল হলে অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হবেন ইনশাল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক বিষয় সঠিকভাবে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।

