সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সাহাবিদের ভালোবাসা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

সাহাবিদের ভালোবাসা

প্রকৃত ও নিখাদ ভালোবাসার সবচেয়ে বড় উদাহরণ নবীজির সাহাবিরা। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি, সন্তানের প্রতি, মা-বাবার প্রতি, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ও সব মুমিনের প্রতি তাঁদের ভালোবাসার কমতি ছিল না। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য তাঁদের ভালোবাসা ছিল সবচেয়ে বেশি। এতে ছিল না কোনো কৃত্রিমতা, লৌকিকতা ও পার্থিব উদ্দেশ্য।

মহানবী (স.)-এর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা দেখার পর মক্কায় গিয়ে উরওয়া ইবনে মাসউদ মন্তব্য করেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি কায়সার, কিসরা এবং নাজ্জাশির মতো সম্রাটদের কাছে গিয়েছি। আল্লাহর শপথ! আমি কোনো বাদশাহকে তার সঙ্গীদের কাছ থেকে এতো মর্যাদা লাভ করতে দেখিনি, যতটা সম্মান ও মর্যাদা মুহাম্মদ (স.)-কে লাভ করতে দেখেছি। ..তিনি কোনো আদেশ করলে সেই আদেশ পালনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি অজু করতে শুরু করলে পরিত্যক্ত পানি গ্রহণে সঙ্গীদের মধ্যে হুড়াহুড়ি লেগে যায়। তিনি কথা বলতে শুরু করলে তাঁর সঙ্গীরা কণ্ঠস্বর নিচু করে ফেলে। শ্রদ্ধার কারণে সঙ্গীরা তাঁর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় না।’ (আর রাহীকুল মাখতুম)


বিজ্ঞাপন


সাহাবিরা তাঁদের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন নবীজি (স.)-কে। তা না হলে তো প্রকৃত মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, 'সেই পবিত্র সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে পিতা ও সন্তানের চেয়ে বেশি প্রিয় হই' (বুখারি: ১৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, 'তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে পিতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই।' (বুখারি: ১৪)

নবীজির সাহাবিরা কখনও অনৈতিক ও নিন্দনীয় ভালোবাসার ধারে-কাছেও যেতেন না। তাঁদের মধ্যে প্রশংসনীয় ভালোবাসা ছিল পূর্ণমাত্রায়। যেমন—মানুষের প্রতি স্বভাবগত ভালোবাসা, সম্মানী ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা, ভালো কাজের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যে ভালোবাসার মধ্যে তাঁরা ডুব দিতেন সেটা হলো নবীজির প্রতি ভালোবাসা। প্রিয়নবী (স.)-এর জন্য তাঁরা জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। 

তৃতীয় হিজরিতে সংঘটিত ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। একপর্যায়ে তালহা ইবন ওবায়দুল্লাহ (রা.) ঢাল হয়ে মহানবী (স.)-কে রক্ষা করেন। তাঁর শরীরে তীর ও তরবারির ৮০টিরও বেশি আঘাত লেগেছিল। (জাদুল মাআদ: ২/৯৫)

মহানবী (স.) কোনো কথা বললে সাহাবায়ে কেরাম সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তিনি কোনো কিছু জানতে চাইলে তাঁরা বিনয় প্রকাশ করে বলতেন—‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই অধিক অবগত।’ মহানবী (স.)-এর কোনো কিছুতে কষ্ট হওয়া তাঁদের কাছে নিজের আপনজনের কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট লাগত। খুবাইব (রা.) বন্দি হওয়ার পর কাফেররা তাঁর দেহের অঙ্গগুলো বিচ্ছিন্ন করতে করতে বলে, তুমি কি চাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে তোমার পরিবর্তে তোমার নবী মুহাম্মদকে হত্যা করি? খুবাইব (রা.) এই করুণ অবস্থায়ও বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি মুক্তি পেয়ে আমার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাব আর আমার নবী মুহাম্মদ (স.)-এর গায়ে কাঁটার আঁচড় লাগবে, তা হতে পারে না।’ 


বিজ্ঞাপন


ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর করুণ দশা শুনে  একজন বৃদ্ধা ওহুদ ময়দানের দিকে রওনা হন। তাঁর অনেক আপনজন যুদ্ধে এসেছিল। তিনি পথিমধ্যে শুনতে পান তাঁর পুত্র, স্বামী, ভাই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। বৃদ্ধা আল্লাহর প্রশংসা করলেন। পরিশেষে মহানবী (স.)-এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার পুত্র, স্বামী, ভাই শহীদ হয়েছে, এতে আমার কোনো দুঃখ নেই, আপনি বেঁচে আছেন, তাতেই আমি খুশি।’

মহানবী (স.)-এর হিজরতের আগে আলী (রা.)-কে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকতে বলেন। অথচ এটি ছিল বাঁচা-মরার প্রশ্ন। কিন্তু রাসুলের ভালোবাসায় বিনাবাক্যে তা মেনে নেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে যেদিন মহানবী (স.) হিজরতের কথা বলেছেন, সেদিন থেকে হিজরতের রাত পর্যন্ত (প্রায় তিন মাস) বিছানায় পিঠ লাগাননি। কারণ রাসুল (স.) কখন ডাক দেন, তাঁর উঠতে দেরি হয়ে যায় কি না।

মহানবী (স.)-কে সাহাবায়ে কেরাম ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তিনি যেভাবে কথা বলতেন, তাঁরা সেভাবে কথা বলতেন, তিনি যা খেতেন, তাঁরাও তা খেতেন। তিনি যেভাবে পোশাক পরতেন, তাঁরাও সেভাবে পোশাক পরতেন। তবে যেসব আমল ও কাজ রাসুল (স.)-এর জন্য বিশেষায়িত ছিল, তা থেকে তাঁরা বিরত থাকতেন। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) যা করতেন আমি তা পরিহার করব না, বরং আমি তা করব। আমি ভয় পাই যদি আমি তাঁর সামান্য কোনো বিষয় পরিহার করি, তবে পথভ্রষ্ট হবো।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৯৭০)

মুজাহিদ (রহ.) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর এক সফরে সঙ্গে ছিলাম। তিনি একটি স্থান অতিক্রম করার সময় সেখানে পার্শ্বপরিবর্তন করলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি এমন করলেন কেন? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে এমনটি করতে দেখেছি।’ (মুসনাদে আহমদ: ৪৮৭০)

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) এক ব্যক্তির হাতে একটি স্বর্ণের আংটি দেখে সেটি খুলে ফেলে দিলেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আগুনের টুকরা সংগ্রহ করে তার হাতে রাখে। রাসুলুল্লাহ (স.) প্রস্থান করলে লোকটিকে বলা হলো, তোমার আংটি তুলে নাও, এর দ্বারা উপকার লাভ করো। সে বলল, না। আল্লাহর শপথ! আমি কখনো ওটা নেব না। রাসুলুল্লাহ (স.) তো ওটা ফেলে দিয়েছেন।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৩৬৫)

আবু সুফিয়ান (রা.) মুসলিম হওয়ার আগে মহানবী (স.)-এর ঘরে আগমন করলে তাঁর মেয়ে উম্মুল মুমিনিন উম্মে হাবিবা (রা.) তাঁকে মহানবী (সা.)-এর বিছানায় বসতে দেননি। 

এরকম নবীপ্রেমের হাজারো উদাহরণ সাহাবিদের জীবনে রয়েছে। কেননা রাসুল (স.)-এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবী (স.)-এর অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’(আলে ইমরান: ৩১)

রাসুল (স.)-এর সাক্ষাৎলাভে যাঁরা ধন্য হয়েছেন এবং ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের প্রত্যেকেই সাহাবি। তাঁরা উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মানুষ। সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠি। কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য তাঁরা অনুসরণীয়। কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। সাহাবিদের ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা-  رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ অর্থাৎ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।’ (সুরা বাইয়িনা: ৮)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সাহাবীদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর