মানুষ, পশুপাখি ও সকল জীব-জন্তুর অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ। তিনি প্রেম-ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। মা তার সন্তানের জন্য নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেয়, বাবা তার শরীরের রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পরিশ্রম করে যায়। মানুষ তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুর জন্য কখনো জীবন বাজি রাখে। স্বামী-স্ত্রী সারাজীবন একসঙ্গে কাটিয়ে দিতে পারে ভালোবাসার কারণে। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, এটি আল্লাহর রহমতেরই একটি ছোট্ট অংশ।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ রহমতকে এক শ ভাগে বিভক্ত করেছেন। তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ তিনি নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন। আর পৃথিবীতে এক ভাগ পাঠিয়েছেন। ওই এক ভাগ পাওয়ার কারণেই সৃষ্টিজগৎ পরস্পরের প্রতি দয়া করে। এমনকি ঘোড়া তার বাচ্চার ওপর থেকে পা উঠিয়ে নেয় এই আশঙ্কায় যে সে ব্যথা পাবে। (বুখারি: ৬০০০)
সুতরাং ভালোবাসা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক। তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রোম: ২১)
তাই প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এটি নিত্যদিনের। যেকোনো দিন যেকোনো মুহূর্তে বৈধ ক্ষেত্রে বৈধ উপায়ে ভালোবাসার প্রকাশ ইসলাম সমর্থন করে। আর অবৈধ ক্ষেত্রে ও অবৈধ উপায়ে ভালোবাসা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ।
স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি, মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসা, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ও সব মুমিনের প্রতি ভালোবাসা ইসলামে জায়েজ ও সওয়াবের কাজ। তবে সন্তান বা পরিবারের প্রেমে অন্ধ হয়ে গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আল্লাহর নাফরমানির সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই। যদি করা হয়, তাহলে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, বলে দাও, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা, যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত।’ আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না। (সুরা তাওবা: ২৪)
সর্বোৎকৃষ্ট ভালোবাসা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা। প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে নবীপ্রেম থাকা ঈমানের দাবি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবী (স.)-এর অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’(আলে ইমরান: ৩১)
মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে হবে নবীজি (স.)-কে। তা না হলে প্রকৃত মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, 'সেই পবিত্র সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে পিতা ও সন্তানের চেয়ে বেশি প্রিয় হই' (বুখারি: ১৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, 'তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে পিতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই।' (বুখারি: ১৪)
ইসলামে বেগানা নর-নারীর কোনো নির্জন স্থানে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম। কারণ তাতে ব্যভিচার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাই ভালোবাসার নামে এসব গর্হিত কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ব্যভিচার করার আগ্রহ তৈরি হতে পারে এমন কাজের ধারে-কাছে যেতেও কোরআন নিষেধ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা ইসরা: ৩২)
ইসলামের নির্দেশনামতে, কোনো ব্যক্তি শুধু ব্যভিচার থেকে দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবে না, বরং এ পথে ধাবিতকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। হাদিসে এসেছে, ‘যখনই কোনো পুরুষ পর নারীর সঙ্গে নির্জনে দেখা করে তখনই শয়তান সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়।’ (তিরমিজি: ২১৬৫)। আর শয়তান তাদের ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে।
বিবাহবহির্ভূত যেকোনো যৌনাচারকে ‘ব্যভিচার’ বলে গণ্য করেছে ইসলাম। হাদিসে এসেছে, ‘দুই চোখের ব্যভিচার হলো পরনারীর প্রতি নজর করা, দুই কানের ব্যভিচার হলো যৌন উত্তেজক কথাবার্তা শ্রবণ করা, মুখের ব্যভিচার হলো পর নারীর সঙ্গে রসালো কণ্ঠে কথা বলা। হাতের ব্যভিচার হলো পর নারীকে স্পর্শ করা এবং পায়ের ব্যভিচার হলো যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে পর নারীর কাছে গমন করা। অন্তরের ব্যভিচার হলো হারাম বস্তু কামনা করা; আর যৌনাঙ্গ তা বাস্তবায়ন করে বা মিথ্যা সাব্যস্ত করে।’ (মুসলিম: ৬৯২৫)
তাই বেহায়াপনা থেকে মুমিনদের দূরে থাকতে হবে এবং অন্যায়কাজে সাধ্যানুযায়ী বাধা দিতে হবে। তবে, সতর্ক থাকতে হবে যে, কোনোভাবেই যেন অমুসলিম কিংবা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা না হয়। তাদের সংস্কৃতিতেও যেন আঘাত করা না হয়। তারা তাদের সংস্কৃতি পালন করুক। সামাজিকভাবে তাদেরকে হেয় করা কিংবা তাদের প্রতি খারাপ আচরণ করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদেরই থাকুক, আমার ধর্ম আমার।’ (সুরা কাফিরুন: ৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

