বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

তারাবি নামাজ: সুন্নাহভিত্তিক নিয়ম ও দোয়া

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২২, ১২:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

তারাবি নামাজ: সুন্নাহভিত্তিক নিয়ম ও দোয়া

তারাবি (تَرَاوِيْح) শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো বিশ্রাম করা। দীর্ঘ কেরাতে এ নামাজ পড়ার কারণে চার রাকাত পরপর খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া হয়, তাই একে তারাবি বা তারাবিহ নামকরণ করা হয়েছে। রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে তারাবি নামাজ নেই; এটি শুধু রমজানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

আল্লাহর রাসুল (স.) নিয়মিত সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ আদায় করলে, তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল বিধায় তিনি পুরো রমজানজুড়ে তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করেননি। 


বিজ্ঞাপন


তারাবির নামাজ আদায় করলে জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—

‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়বে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ৩৬, খণ্ড ১)

তারাবি নামাজের প্রচলন
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবির নামাজ পড়ার প্রচলন ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর যুগে। সাহাবায়ে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা সুন্নত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। 

তারাবি নামাজের নিয়ত
নিয়ত শব্দের অর্থ হলো, মনের ইচ্ছা, সঙ্কল্প বা প্রতিজ্ঞা। এটি অন্তরের কাজ, জিহ্বার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোনো কাজের শুরুতে মনের মধ্যে যে ইচ্ছা পোষণ করা হয়, সেটাকেই নিয়ত বলা হয়। আবার কেউ চাইলে এ ইচ্ছা বাংলায়ও করতে পারেন।


বিজ্ঞাপন


যদি এভাবে নিয়ত করা হয় যে, তারাবির দুই রাকাত নামাজ কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর জন্য (ইমামের পেছনে ইকতেদা করে) পড়ছি- (اَللهُ اَكْبَر) আল্লাহু আকবর—তাতেও ইসলামিক স্কলারদের মতে নিয়ত শুদ্ধ হবে।

তারাবি নামাজ পড়ার নিয়ম
দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে সালাম ফিরিয়ে আবার দুই রাকাআত নামাজ পড়া। এভাবে ৪ রাকাআত আদায় করার পর একটু বিশ্রাম নেওয়া। বিশ্রামের সময় তাসবিহ তাহলিল পড়া, দোয়া-দরূদ ও জিকির আজকার করা। তারপর আবার দুই দুই রাকাআত করে আলাদা নিয়তে তারাবি আদায় করা।

তারাবি নামাজের দোয়া
৪ রাকাআত তারাবি আদায় করার পর ব্যাপক প্রচলিত একটি দোয়া রয়েছে। যা দেশের প্রায় মসজিদে পড়া হয়। আর তাহলো-
سُبْحانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ سُبْحانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظْمَةِ وَالْهَيْبَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوْتِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِيْ لَا يَنَامُ وَلَا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدَ سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّنا وَرَبُّ المْلائِكَةِ وَالرُّوْحِ
উচ্চারণ: ‘সুবহানা জিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা জিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা; সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’

উল্লেখ্য, এ দোয়ার সঙ্গে তারাবি নামাজ হওয়া কিংবা না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন নয় যে, এ দোয়া না জানলে তারাবি নামাজ শুদ্ধ হবে না। বরং যে কোনো দোয়াই পড়া যাবে। তবে, এ সময়টিতে সুন্নাহসমর্থিত দোয়াগুলো পড়াই উত্তম।

তারাবির নামাজের রাকাতসংখ্যা
তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মত। সাহাবী, তাবেয়িদের মতও এটি। ৪ মাজহাবের ইমামগণ এই মতের ওপর একমত। তবে, ইমাম মালিক (রা.)-এর প্রথম বক্তব্য ২০ রাকাত হলেও, দ্বিতীয় বক্তব্য ৩৬ রাকাতের পক্ষে (যাতে বিশ তারাবি আর ১৬ রাকাত নফল)। (হেদায়াতুল মুজতাহিদ-১/১৬৭) 

পবিত্র কাবায়ও ২০ রাকাত তারাবি পড়ানো হয়। একই নিয়ম মসজিদে নববিতেও। এমনকি হজরত ওমর (রা.)-এর পর উসমান (রা.) এবং আলী (রা.)-এর শাসনামলেও ২০ রাকাত তারাবিই পড়া হতো মদিনা তাইয়্যেবায়। কেউ কোনোসময় এ বিষয়ে বিতর্ক করেননি। আজ পর্যন্ত কখনও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। তাই সাহাবায়ে কেরামের সুন্নত ২০ রাকাত তারাবিকে আট রাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা অনুচিত। 

তাবেয়ি ইবনে আবি জুবাব (রহ) বলেন, ‘ওমর (রা.)-এর যুগে রমজানের তারাবি ছিল ২৩ রাকাত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭৭৩৩)
প্রখ্যাত তাবেঈ আবদুল আজিজ ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, ‘উবাই ইবনে কাব (রা.) রমজানে মদিনায় লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৭৭৬৬)

পৃথিবীর প্রথম সহিহ হাদিসগ্রন্থ ‘মুয়াত্তা মালিক’সহ অন্যান্য কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, তাবেঈ ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রহ.) বলেন, ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে লোকেরা রমজানে ২৩ রাকাত তারাবি পড়তেন।’ (মুয়াত্তা মালিক: ৩৮০; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকি: ৪২৪৯)

যে হাদিসে আট রাকাতের কথা আছে, সেটি মূলত তাহাজ্জুদসংক্রান্ত হাদিস। মহানবী (স.) রমজানে ও রমজানের বাইরে প্রতি রাতে আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতরের নামাজ পড়তেন। সেটি বুঝতে ভুল করার কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মুহাদ্দিসিনে কেরাম এই হাদিসকে তারাবির রাকাতসংখ্যার অধ্যায়ের পরিবর্তে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে কেন উল্লেখ করেছেন—এটি নিয়ে চিন্তা করলেও আর বিতর্ক থাকে না। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক দিন। 

তারাবি নামাজের মোনাজাত
অনেকেই ৪ রাকাআত পর পর মোনাজাত করে থাকেন। আবার অনেকে পুরো নামাজ শেষ করে মুনাজাত করেন। তবে, নামাজ শেষ করে বিতর পড়ে মোনাজাত করাই উত্তম। মোনাজাতের ক্ষেত্রে একটি দোয়া ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এ মোনাজাতকেও অনেকে আবশ্যক মনে করেন। কেউ এমনও মনে করেন যে, এ দোয়াটি ছাড়া তারাবি নামাজের মোনাজাত হবে না। এটি মোটেও ঠিক নয়। তবে এ দোয়ায় মোনাজাত করলে যে গোনাহ হবে, তা-ও ঠিক নয়।

মোনাজাতটি হলো-
اَللَهُمَّ اِنَّا نَسْئَالُكَ الْجَنَّةَ وَ نَعُوْذُبِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةَ وَالنَّارِ- بِرَحْمَتِكَ يَاعَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَاجَبَّارُ يَاخَالِقُ يَابَارُّ - اَللَّهُمَّ اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ- بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّحِمِيْنَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনাননার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বিরাহমাতিকা ইয়া আঝিঝু ইয়া গাফফার, ইয়া কারিমু ইয়া সাত্তার, ইয়া রাহিমু ইয়া ঝাব্বার, ইয়া খালিকু ইয়া বার্রু। আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার। ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝির। বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’
উল্লেখ্য, রমজানজুড়ে কিছু দোয়া বেশি বেশি করা জরুরি। আর তাহলো-

اَﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺇﻧَّﻚَ ﻋَﻔُﻮٌّ ﺗُﺤِﺐُّ اﻟْﻌَﻔْﻮَ ﻓَﺎﻋْﻒُ ﻋَﻨِّﻲ উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি।
তাছাড়া তারাবি নামাজের পর সাইয়্যিদুল ইসতেগফারও পড়া যেতে পারে-
- اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি; ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আ’হদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু আবুউলাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া; ওয়া আবুউ বিজামবি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।’

মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মহাঅনুগ্রহের মাস রমজান। এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হলো তারাবি নামাজ। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাযথভাবে তারাবি নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অতীত জীবনের সকল গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর