রোজা ভঙ্গের মূল কারণ ৭টি। নিচে কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
১. স্ত্রী সহবাস করা
সহবাসের ফলে সাওম ভঙ্গ হয়; সে যদি সাওম ওয়াজিব অবস্থায় রমজানের দিনে সহবাস করে, তাহলে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে। কাফফারা হচ্ছে গোলাম আজাদ করা, যদি তা না পাওয়া যায়, তাহলে টানা দুমাস সাওম পালন করা, যদি সামর্থ না থাকে, তাহলে ৬০জন মিসকিনকে খাদ্য দান করা। এর দলিল হচ্ছে- আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি নবী (স.)-এর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি ধ্বংস হয়েছি। নবী (স.) বললেন: কিসে তোমাকে ধ্বংস করল? সে বলল, আমি রমজানে (দিনের বেলা) স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে ফেলেছি। তিনি বললেন: তুমি কি একটি ক্রীতদাস আজাদ করতে পারবে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে লাগাতার দুই মাস রোজা রাখতে পারবে? সে বলল, না। তিনি বললেন, তাহলে ৬০ জন মিসকিনকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না...(সহিহ বুখারি: ১৯৩৬ ও সহিহ মুসলিম: ১১১১)
বিজ্ঞাপন
যদি সহবাসকারীর ওপর সাওম ওয়াজিব না থাকে, যেমন মুসাফির, তাহলে তার ওপর কাজা ওয়াজিব হবে, কাফফারা নয়।
২. সহবাস ছাড়া অন্য যেকোনো উপায়ে বীর্যপাত
সাওম অবস্থায় স্পর্শ বা চুম্বন ইত্যাদির মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটানো রোজা ভঙ্গের কারণ। যদি চুম্বনের ফলে বীর্য বের না হয়, তাহলে তার ওপর কিছু ওয়াজিব হবে না। হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে তার উপর ফরজ হচ্ছে— তওবা করা, সে দিনের বাকী সময় উপবাস থাকা এবং পরবর্তীতে সে রোজাটির কাজা আদায় করা। আর যদি এমন হয়— হস্তমৈথুন শুরু করেছে বটে; কিন্তু বীর্যপাতের আগে সে বিরত হয়েছে, তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে; তার রোজা সহিহ। বীর্যপাত না করার কারণে তাকে রোজাটি কাজা করতে হবে না। রোজাদারের উচিত হচ্ছে— যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সবকিছু থেকে দূরে থাকা এবং সব কুচিন্তা থেকে নিজের মনকে প্রতিহত করা। আর যদি, মজি বের হয়, তাহলে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী— এটি রোজা ভঙ্গকারী নয়।
৩. পানাহার করা
মুখ দিয়ে কোনো কিছু পাকস্থলীতে পৌঁছানো। অনুরূপভাবে নাক দিয়ে কোনো কিছু যদি পাকস্থলীতে পৌঁছানো হয়, সেটাও পানাহারের পর্যায়ভুক্ত। এ কারণে নবী (স.) বলেছেন: ‘তুমি ভাল করে নাকে পানি দাও; যদি না তুমি রোজাদার হও” (সুনানে তিরমিজি: ৭৮৮, আলবানি হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন) সুতরাং নাক দিয়ে পাকস্থলীতে পানি প্রবেশ করানো যদি রোজাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করত, তাহলে নবী (স.) ভাল করে নাকে পানি দিতে নিষেধ করতেন না। এছাড়াও সাওম পালনকারীর জন্য ঘ্রাণ জাতীয় ধোঁয়া পেটে নেওয়া বা গলাধঃকরণ করা (ধূমপান) বৈধ নয়; কারণ, ধোঁয়ার শরীর আছে, তবে সুঘ্রাণ জাতীয় দ্রব্য শুকলে (গলাধঃকরণ করলে) সমস্যা নেই।
৪. খাদ্যানুরূপ কিছু গ্রহণ করা
যেমন, খাদ্য জাতীয় ইনজেকশন নেওয়া। কারণ এমন ইনজেকশন নিলে পানাহারের প্রয়োজন হয় না। (শাইখ উছাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রমাদান’, পৃষ্ঠা- ৭০)
তবে, যেসব ইনজেকশন পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয়; বরং চিকিৎসার জন্য দেয়া হয়, যেমন ইনসুলিন, পেনেসিলিন কিংবা শরীর চাঙ্গা করার জন্য দেওয়া হয় কিংবা টীকা হিসেবে দেওয়া হয় এগুলো রোজা ভঙ্গ করবে না; চাই এসব ইনজেকশন মাংশপেশীতে দেয়া হোক কিংবা শিরাতে দেয়া হোক। (শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম এর ফতোয়াসমগ্র (৪/১৮৯)] তবে, সাবধানতাস্বরূপ এসব ইনজেকশন রাতে নেওয়া উত্তম।
বিজ্ঞাপন
কিডনি ডায়ালাইসিস এর ক্ষেত্রে রোগীর শরীর থেকে রক্ত বের করে সে রক্ত পরিশোধন করে কিছু কেমিক্যাল ও খাদ্য উপাদান (যেমন— সুগার ও লবণ ইত্যাদি) যোগ করে সে রক্ত পুনরায় শরীরে পুশ করা হয়; এতেও রোজা ভেঙ্গে যাবে। (ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/১৯)
৫. শিঙ্গা লাগানো
শিঙ্গা লাগানো বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে শিঙ্গার পরিমাণ রক্ত বের করা, যে কারণে শরীর দুর্বল হয়। দলিল হচ্ছে— “যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোজা ভেঙ্গে যাবে।” (সুনানে আবু দাউদ: ২৩৬৭), আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (২০৪৭) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)
রক্ত দেওয়াও শিঙ্গা লাগানোর পর্যায়ভুক্ত। কারণ রক্ত দেয়ার ফলে শরীরের উপর শিঙ্গা লাগানোর মত প্রভাব পড়ে। তাই রোজাদারের জন্য রক্ত দেওয়া জায়েজ নেই। তবে যদি অনন্যোপায় কোনো রোগীকে রক্ত দেওয়ার দরকার হয়, তাহলে রক্ত দেওয়া জায়েয হবে। তবে, রক্ত দানকারীর রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং সেদিনের রোজা কাজা করতে হবে। (শাইখ উছাইমীনের ‘মাজালিসু শারহি রামাদান’ পৃষ্ঠা-৭১)
কোনো কারণে যে ব্যক্তির রক্তক্ষরণ হচ্ছে— তার রোজা ভাঙ্গবে না; কারণ রক্তক্ষরণ তার ইচ্ছাকৃত ছিল না। (স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/২৬৪)
আর দাঁত তোলা, ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা কিংবা রক্ত পরীক্ষা করা ইত্যাদি কারণে রোজা ভাঙ্গবে না; কারণ এগুলো শিঙ্গা লাগানোর পর্যায়ভুক্ত নয়। কারণ এগুলো দেহের উপর শিঙ্গা লাগানোর মকো প্রভাব ফেলে না।
৬. ইচ্ছাকৃত বমি করা
অর্থাৎ পেট থেকে খানা অথবা পানীয় জাতীয় কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে বের করা। ইবনে মুনযির বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করেছে, আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অভিমত (ইজমা) হচ্ছে, তার রোজা ভেঙ্গে গেছে।’ (আল-মুগনী: ৪/৩৬৮)
৭. নারীদের হায়েজ ও নেফাস
নারীদের মাসিক ঋতু ও সন্তান প্রসবজনিত কারণে রক্তস্রাব। এ দুইরকম রক্তস্রাব শুরু হলে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে; এমনকি সেটা সূর্যাস্তের সামান্য কিছু সময় পূর্বে হলেও। আর কোনো নারী যদি অনুভব করেন যে, তার হায়েজ শুরু হতে যাচ্ছে; কিন্তু সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত রক্ত বের হয়নি, তাহলে তার রোজা শুদ্ধ হবে এবং সেদিনের রোজা তাকে কাজা করতে হবে না। আর হায়েজ ও নিফাসগ্রস্ত নারীর রক্ত যদি রাত থাকতে বন্ধ হয়ে যায় এবং সাথে সাথে তিনি রোজার নিয়ত করে নেন; তবে গোসল করার আগেই ফজর হয়ে গেলে, সেক্ষেত্রে আলেমদের মাজহাব হচ্ছে—তার রোজা শুদ্ধ হবে।
হায়েজবর্তী নারীর জন্য উত্তম হচ্ছে, হায়েজ-রোধকারী কোনো কিছু ব্যবহার না-করা। স্বাভাবিক নিয়মে হায়েজের সময় রোজা ভাঙ্গা এবং পরবর্তীতে সেই রোজা কাজা পালন করা। উম্মুল মুমিনিনগণ এবং সলফে সালেহিন নারীগণ এভাবেই আমল করতেন। (স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র: ১০/১৫১)
তিনটি শর্তসাপেক্ষে উল্লেখিত সাতটি কারণে সাওম ভঙ্গ হবে। শর্তগুলো হলো-
ক. সাওম ভঙ্গের হুকুম ও সাওমের সময় সম্পর্কে জানা থাকা।
খ. সাওমের কথা স্মরণ থাকা।
গ. ইচ্ছাকৃতভাবে এসব কাজ করা।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুক। আমিন।
(সূত্র: ইসলামকিউ, সংক্ষেপিত)

