শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইসলামে গেম খেলা কতটা গ্রহণযোগ্য

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসলামে গেম খেলা কতটা গ্রহণযোগ্য

খেলাধুলায় একদিকে শরীর চর্চা ও মেধাবিকাশ হয়, অন্যদিকে তা দীনি দায়িত্বে গাফিলতি ও জুয়ার মাধ্যম। তাই ইসলাম ঢালাওভাবে খেলাধুলা বা বিনোদনের অনুমতি দেয়নি আবার সব খেলাধুলা, গেমস বা বিনোদনকে নিষিদ্ধও করেনি। মূলত খেলা যদি কেবল সময়ের অপচয়ের মাধ্যম হয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দীন থেকে গাফেল হয় এবং তাতে জুয়ার মিশ্রণ থাকে, তখন ওই খেলা হারামে পরিণত হয়।

একদিন দুজন আনসার সাহাবি তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা করছিলেন। হঠাৎ একজন বসে পড়লেন। তখন অপরজন বিস্মিত হয়ে বললেন, কী ব্যাপার। কষ্ট হয়ে গেল নাকি? জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি যে, প্রত্যেক বস্তুত যা আল্লাহর স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়, সেটাই অনর্থক..।’ (নাসায়ি, সহিহাহ: ৩১৫)


বিজ্ঞাপন


এতে বুঝা যায় যে, বৈধ খেলাও যদি আল্লাহর স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়, তা জায়েজ হবে না। ইমাম বুখারি (রহ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, ‘প্রত্যেক খেলা-ধুলা বাতিল, যদি তা আল্লাহর আনুগত্য থেকে উদাসীন করে দেয়’ (ফাতহুল বারি ‘অনুমতি গ্রহণ’ অধ্যায় ৭৯, অনুচ্ছেদ ৫২; ১১/৯৪ পৃ)

আল্লাহ তাআলা বলেন, এমন কিছু লোক আছে, যারা অজ্ঞতাবশত বাজে কথা খরিদ করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য এবং সত্য পথকে তারা বিদ্রূপ করে, তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি’। ‘যখন তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে এটা শুনতেই পায়নি। যেন তার দুই কানে বধিরতা রয়েছে। অতএব তুমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।’ (সুরা লোকমান ৬-৭)

সামগ্রিক দিক বিবেচনায় প্রত্যেক খেলা বা গেম ৫ প্রকার। প্রত্যেক প্রকারের বিধান ভিন্ন। খুবই সংক্ষেপে সে ৫ প্রকারের ওপর আলোকপাত করা হলো।

এক: হারাম। এমন কিছু খেলাধুলা রয়েছে, যে খেলাগুলো মৌলিকভাবেই হারাম। যেমন ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, সাপ-বানরের খেলা ইত্যাদি। কারণ এই খেলাগুলোতে বিনোদনের নামে প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া হয়। এক পক্ষের সম্পদ নষ্ট হয়। এমন খেলার আয়োজন করা, দেখা, সবই নিষেধ। ফতোয়ার কিতাবে রয়েছে, ‘সাপ, বেজি, বানর ইত্যাদির খেলা দেখা, দেখানো এবং বিনিময় দেওয়া ও নেওয়া জায়েজ নেই।’ (ফতোয়ায়ে শামি: ৬/৩৪৯, আহসানুল ফতোয়া: ৮/২০৭)

দুই: নীতিগত কারণে হারাম। এমন কিছু খেলাধুলা রয়েছে, যেগুলো মৌলিকভাবে হারাম ছিল না কিন্তু খেলার মধ্যে এমন কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে যেগুলো হারাম। যেমন ফুটবল। যে খেলাটি আসলে হারাম ছিল না, কিন্তু একটি নীতি সেটাকে হারাম করে দিয়েছে। তা হলো এই খেলা হয় হাফপ্যান্ট পরে। আর প্রত্যেক পুরুষের জন্য নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অন্য পুরুষকে দেখানো হারাম। অন্যের জন্য দেখাও হারাম। তাই এই খেলার আয়োজন করা, খেলা, দেখা, সবই নিষেধ। আর যদি নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে খেলা যায়, তাহলে নীতিগতভাবে হারাম হবে না। (সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ৩২৩৫; আবু দাউদ: ৪৯৭; হেদায়া: ১/৯২; ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/২২; ১৮/৯০)

তিন: সংযুক্ত বিষয় হারাম। এসব এমন খেলা যেগুলো মৌলিকভাবে হারাম ছিল না, হারাম শর্ত সংযুক্তিকরণে হারাম হয়েছে। যেমন; বাজি। কোনো খেলায় যদি বাজি ধরা হয়, তাহলে সেটা হারাম হয়ে যাবে। বাজির খেলার আয়োজন করা, খেলা, দেখা, সবই নিষেধ। বাজির টাকা লেন-দেনও নিষেধ। (সুরা মায়েদা: ৯০-৯১; আবু দাউদ: ৩৬৮৫)

চার: শর্তসাপেক্ষে হালাল। যেসব খেলাধুলা উপরোল্লিখিত ৩ পর্যায়ের নয়, সেসব খেলাধুলা কিছু শর্তে হালাল হবে। শর্তের মধ্যে রয়েছে- ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষতিকারক কিছু থাকতে পারবে না। খেলাটি খেলোয়াড় বা দর্শকদের ইসলামের আবশ্যকীয় বিধান পালনে প্রতিবন্ধক হবে না, যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি। যদি খেলা বা দেখার কারণে নামাজ, রোজা ইত্যাদি আদায় করা যায় না, তাহলে সে খেলা হালাল হবে না। যেমন দাবা খেলা, ক্যারম খেলা ইত্যাদি। এসব খেলা যথাযথ নামাজ আদায়ের পরিপন্থী। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩৫২; আল বাহরুর রায়েক: ৮/১৮৯, ফতোয়ায়ে শামি: ৬/৩৯৫)

পাঁচ: কিছু খেলা শর্তসাপেক্ষে সুন্নত। অবাক করার মতো হলেও কিছু খেলা সুন্নত। যেমন তীর নিক্ষেপ, সাঁতার, ঘোড়দৌড়, পর্দা রক্ষা করে স্ত্রীর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা। রাসুলুল্লাহ (স.) তীর নিক্ষেপকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘আল্লাহ একটি তীরের ওসিলায় তিনজন লোককে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন—তীর নির্মাতা যে নির্মাণকালে কল্যাণের আশা করেছে, এই তীর নিক্ষেপকারী এবং তা নিক্ষেপে সাহায্যকারী। তিনি আরো বলেন, তোমরা তীরন্দাজি করো ও ঘোড়দৌড় শিক্ষা করো। তবে তোমাদের ঘোড়দৌড় শেখার তুলনায় তীরন্দাজি শেখা আমার কাছে বেশি পছন্দনীয়।’ (সুনানে তিরমিজি: ১৬৩৭)

অতএব যুদ্ধের ট্রেনিং সংক্রান্ত সৈনিকদের জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা সুন্নত। আবার শরিয়তের বিধান মেনে স্ত্রীর সঙ্গে বিনোদনমূলক খেলাধুলাও সুন্নত। রাসুল (স.) আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর দৌড় খেলায় অংশ নিয়েছেন। (আস-সুনানুল কুবরা লিন-নাসায়ি: ৮৯৪৫)

উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে অনলাইন গেমসও বৈধ হতে পারে, যদি তাতে গান-বাজনা ও বেপর্দার কিছু না থাকে। তবে ইসলামে অনর্থক গেমসে সময় কাটানোর অনুমতি নেই। এজন্যই পবিত্র কোরআনে মুমিনদের উত্তম ও প্রশংসনীয় গুনাবলীর প্রশংসায় বলা হয়েছে, যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত, (মু'মিনুন: ৩)। ‘এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়।’ (সুরা ফুরকান: ৭৩) 

উল্লেখিত আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, শরিয়তে সময়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া ও লক্ষস্থির জীবন গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং নেক উদ্দেশ্যহীন সকল কাজ থেকে মুমিন দূরে থাকবে। আর অধিকাংশ খেলাই হচ্ছে নিছক উদ্দেশহীন। আরবিতে যাকে লাগু বলা হয়। লাগু ওই সকল অনর্থক কথাবার্তা ও কাজ-কর্ম যাতে গান-বাদ্য রং তামাশা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর লাহব বলা হয়- যে সকল বস্তু মানুষকে লক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী থেকে অমনোযোগী করে দেয়। (কুরতুবি:১৩/৮০)

শেষকথা হলো- যেসব খেলা মৌলিকভাবে হারাম, রীতি-নীতির কারণে হারাম, সংযুক্ত বিষয় হারাম হওয়ার কারণে হারাম এবং ইসলামের আবশ্যকীয় বিধান লঙ্ঘন হওয়ার কারণে হারাম, সেসব খেলার আয়োজন, দেখা, সহযোগিতা করা, সাপোর্ট করা সবই হারাম। আর যেসব খেলায় উল্লেখিত বিষয়গুলো নেই, সেসব খেলার আয়োজন করা, দেখা, সহযোগিতা করা, সাপোর্ট করা জায়েজ। 

মনে রাখতে হবে খেলার কারণে সাধারণত মূল্যবান সময়ের অপচয় হয়। তাই শরীর চর্চার উপাদান রয়েছে—এমন খেলা বাছাই করা উত্তম। তাহলে সময় অপচয় বলে বিবেচিত হবে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের বুঝার তাওফিক দিন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর