ইসলামের দৃষ্টিতে সেলফি একটি বাজে আসক্তি। যদিও বর্তমানে নিজেকে প্রদর্শনের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম এটি। সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েবক্যামে ধারণ করা হয় সেলফি এবং যেকোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হয়ে থাকে। সেলফি শব্দটি ইংরেজি সেলফিশ থেকে এসেছে। এর অর্থ আত্মপ্রতিকৃতি। অক্সফোর্ড অভিধানের মতে, সেলফি হলো একটি ছবি (আলোকচিত্র), যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি।
১৮৩৯ সালে রবার্ট কর্নিলিয়াস নামের একজন মার্কিন আলোকচিত্রী প্রথম সেলফি তুলেছিলেন বলে দাবি করা হলেও অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে, সেলফির উত্থান ঘটে মূলত পর্নো সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। তাঁদের দাবি, নিজেদের শরীর সুন্দরভাবে প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্যই নারীরা সেলফি তুলত। নিজেকে আকর্ষণীয় করাই ছিল সেলফির মূল উদ্দেশ্য। যদিও ২০১০ সালের পরবর্তী সময় থেকে মুখ বাঁকিয়ে, চোখ রাঙিয়ে কিংবা উদ্ভট অঙ্গভঙ্গিতে প্রতিবন্ধীর মতো সেলফি তোলাই ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া, স্টারলাইট ডটকম)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: যে ৪ গুনাহ করার সময় ঈমান থাকে না
বর্তমানে কে কত ইউনিকভাবে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে পারে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কেউ তো হজ করতে গিয়েও কাবাঘরের সামনে সেলফিতে মগ্ন হয়ে পড়ছেন। তা আবার আপলোডও করছেন। অথচ নেক আমল ধ্বংস করার জন্য সেলফি বড় ভূমিকা রাখছে। নিছক অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়েই শেষ হচ্ছে নিত্যকার আমল। যেখানে নেই ইখলাস ও তাকওয়া। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তাদেরকে কেবল এই আদেশই দেওয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই জন্য নিবেদিত রেখে নামাজ কায়েম করবে ও জাকাত দেবে। আর এটাই সরল-সঠিক উম্মতের দীন।’ (সুরা বাইয়িনা: ৫)
ইখলাস ও আন্তরিকতার এই শিক্ষা ও চেতনা ছড়িয়ে থাকার কথা একজন মুমিনের জীবনজুড়ে। এর সৌরভে সুরভিত থাকবে মুমিন জীবনের প্রতিটি অধ্যায়। মনে রাখা উচিত- আল্লাহর কাছে কেবল হৃদয়ের বিশুদ্ধতাই পৌঁছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের (কোরবানির পশুর) গোশত আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের ‘তাকওয়াই’ পৌঁছে।’ (সুরা হজ: ৩৭)
বিজ্ঞাপন
প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য এ আয়াতে এই গভীর শিক্ষা রয়েছে, আমাদের ইবাদত-বন্দেগি যেন শুধু অঙ্গভঙ্গিতে রূপান্তরিত না হয়। আমাদের প্রতিটি আমলই হয় যেন শুধু আল্লাহর জন্য, মানুষকে দেখানোর জন্য নয়। কারণ আল্লাহ আমাদের অন্তর দেখেন। অথচ কোরবানির মতো ইবাদতকেও আমরা তাকওয়াবিরোধী কাজ সেলফি তোলার মাধ্যমে নষ্ট করে দিচ্ছি। যা সত্যিই দুঃখজনক।
তাছাড়া সেলফি তোলার মূল উদ্দেশ্যই হলো আত্মপ্রদর্শন। এটাকে শরিয়তের ভাষায় ‘রিয়া’ বলে। এই প্রদর্শন যদি হয় ইবাদতের ক্ষেত্রে তা হতো আমাদের ঈমানকে ধ্বংস করার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কেননা রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি লোক দেখানো ইবাদত করে, আল্লাহ তাআলা বিনিময়স্বরূপ তার লোক দেখানো উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪৯৯)
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে উল্লেখ আছে, মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, তিনি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘সামান্যতম রিয়াও (লোক দেখানো আমল) শিরক।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৯৮৯)
আরও পড়ুন: সেলফি প্রবণতা হজের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী
সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, সেলফি হলো, আত্মতৃপ্তি ও আত্মপ্রদর্শনের একটি মাধ্যম। আর ইবাদত হলো সম্পূর্ণ আল্লাহর জন্য। তাই ইবাদতের মধ্যে সেলফির অনুপ্রবেশ ঘটানো মোটেই সমীচীন নয়। এতে আমল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিজীবনেও এর প্রভাব খুবই খারাপ।
অতিরিক্ত সেলফিপ্রবণতা নিয়ে গবেষকরা বলছেন, এটি ভয়ংকর ও বিপজ্জনক হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কটি নিশ্চিত করেছে। (দৈনিক প্রথম আলো: ০৩-০৪-২০১৪)। এই মানসিক সমস্যাটির নাম সেলফিটিস। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা খুব বেশি সেলফি তোলে তারা সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় দেয়। সেলফি আক্রান্তদের বেশির ভাগই কর্মজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় এবং সাধারণদের চেয়ে তাদের কনফিডেন্ট লেভেলও কম থাকে। তারা হতাশা ও মেন্টাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। যাদের খুব বেশি সেলফি তুলতে ইচ্ছা হয়, তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন। (আলোকিত বাংলাদেশ: ০৮-০৪-২০১৫)
আরও পড়ুন: তওবার নামাজ পড়ার নিয়ম
সেলফি আসক্তির কারণে কত মানুষের প্রাণ গেছে ইয়ত্তা নেই। চলন্ত ট্রেনের সামনে, বহুতল ভবনের ছাদে, হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে, পাহাড়ের চূড়ায় সেলফি তুলতে গিয়ে বিশ্বে অনেক মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপারেশন ২০১৪ সালকে ‘ইয়ার অব দ্য সেলফি’ ঘোষণা করেছে। তাদের গবেষণা মতে, ২০১৪ সালে প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ গাড়ি চালানো অবস্থায় সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। (সূত্র: https://crashstats. nhtsa.dot. gov/Api /Public/ViewPublication/812260)
ইসলামে সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশে সেলফির তোলা তো দূরের কথা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ছবি তোলারও সুযোগ নেই। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হাশরের দিন সর্বাধিক আজাবে আক্রান্ত হবে তারাই, যারা কোনো প্রাণীর ছবি তোলে অথবা আঁকে।’ (বুখারি: ৫/২২২২)
তাই আসুন, আমরা সেলফির মতো অনর্থক কাজ থেকে তাওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসি। আল্লাহ তাআলা তাওফিক দান করুন। আমিন।

