ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ মিলিয়ে শেষ হয় একটি বছর। শুরু হয় নতুন এক আয়োজন, নতুন এক অধ্যায়। নতুন বছর বরণের আয়োজনটা ঘটে করে পালন করেন অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণে। তবে একজন মুমিনের উচিত- ফেলে আসা দিনগুলোর ভালো-মন্দ হিসাব করা এবং আগামীর জন্য পরিকল্পনা করা। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকের উচিত আগামীর জন্য সে কী করেছে তা খতিয়ে দেখা..।’ (সুরা হাশর: ১৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)
নতুন বছর বা নওরোজ উদযাপন বলতে ইসলামে কিছু নেই। পটকা ফোটানো, হৈ-হুল্লোড় ইত্যাদি অমুসলিমদের সংস্কৃতি। ইসলামে এসবের অনুমোদন নেই। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (কেয়ামতের দিন) তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আবুদাউদ, মেশকাত: ৪৩৪৭)
মুসলমানের কাছে প্রতিটি দিন মূল্যবান। প্রত্যেকটি সকাল মানেই নতুন আরেকটি সুযোগ। সেই সুযোগটি হলো নিজের ঈমান-আমলকে সমৃদ্ধ করার। ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর দাদা তাঁর পিতা সাবিত (রহ.)–কে পারস্যের নওরোজের দিনে হজরত আলী (রা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং হজরত আলী (রা.)–কে কিছু হাদিয়া পেশ করেছিলেন। হাদিয়াটি ছিল নওরোজ উপলক্ষে। তখন হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘নওরোজুনা কুল্লা ইয়াওম।’ অর্থাৎ মুমিনের নওরোজ প্রতিদিনই। মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব-নিকাশ করবে এবং নতুন উদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। (আখবারু আবি হানিফা রহ.)
সাহাবায়ে কেরাম ও মুসলিম মনীষীরা পেছনে ফেলে আসা বিষয়ের ভালো-মন্দ হিসাব করার বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, (আখেরাতে) তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে নিজেরা নিজেদের হিসাব করো। একইভাবে আমল পরিমাপের আগে নিজেরা একটু মেপে দেখো। কেননা আগামী দিনের হিসাব-নিকাশের আগে আজ নিজের হিসাব মিলিয়ে নেওয়া সহজ। (ইগাসাতুল লাহফান, পৃষ্ঠা-৯৪)
বছরের শুরুতে উৎসবের নামে অনর্থক কাজ যেমন পটকা ফোটানো, হৈ-হুল্লোড় করা মুসলমানের জন্য শোভনীয় নয়। এতে গভীর রাতে রোগী, শিশু-বৃদ্ধদের কষ্ট হয়। ভালো কাজের জন্যও এরকম বিকট শব্দ ইসলামে অপছন্দনীয়। ওমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে নববিতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করতেন। এতে হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হত। তাই তিনি ওমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে তিনি তাকে শাস্তি দেন। (আখবারু মদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ: ১/১৫)
বিজ্ঞাপন
সুতরাং উৎসবের নামে যেকোনো অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা ইসলামে শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি: ২৩১৮)
নতুন বছরে অনর্থক কাজকর্ম থেকে মুসলমানদের বিরত থাকতে হবে। আগামীর দিনগুলো যেন সুন্দর ও কল্যাণকর হয় সেজন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম বলেন- আল্লাহর রাসুল (স.)-এর সাহাবিরা নতুন মাসের শুরুতে এই দোয়া পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন। দোয়াটি হলো-
اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ، وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلَامَةِ، وَالْإِسْلَامِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমানি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন।’ (আল-মুজাম আল-আওসাত: ০৬/২২১)
দোয়াটি এভাবেও পড়া যায়— اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ ، وَالإِيمَانِ ، وَالسَّلامَةِ ، وَالإِسْلامِ ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমান।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। (মু’জামুস সাহাবাহ: ০৩/৫৪৩; আল-ইসাবাহ: ০৬/৪০৭-৪০৮)
আগামীর দিনগুলো কল্যাণকর হওয়ার জন্য আরেকটি সুন্দর দোয়া হলো—اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي وَزِدْنِي عِلْمًا الْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حَالٍ وَأَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ حَالِ أَهْلِ النَّارِ ‘আল্লাহুম্মানফা’নি বিমা আল্লামতানি, ওয়া আল্লিমনি মা ইয়ানফাউনি ওয়া জিদনি ইলমা, আলহামদু লিল্লাহি আলা কুল্লি হা-ল, ওয়া আউজুবিল্লাহি মিন হা-লি আহলিন না-র।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাকে তুমি যা শিখিয়েছ তা দিয়ে আমাকে উপকৃত কর, আমার জন্য যা উপকারী হবে তা আমাকে শিখিয়ে দাও এবং আমার ইলম (জ্ঞান) বাড়িয়ে দাও। সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা এবং আমি জাহান্নামিদের অবস্থা থেকে হেফাজতের জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (স.) এই দোয়া করতেন।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৯)
চন্দ্রবছরের ক্ষেত্রে এই দোয়াটি পড়া সুন্নত—اللهم أهله علينا بالأمن والإيمان، والسلامة والإسلام، ربنا وربك الله ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, তুমি ওই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত করো নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে। (হে চাঁদ!) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।’ সাহাবি তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি (স.) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন। (তাবরানি: ১২/৩৫৬; মাজমাউজ জাওয়াইদ: ১০/৩৫৬; সুনান আদ-দারিমি: ১৭২৫)
ইসলামে নতুন বছরের অনেক করণীয় রয়েছে। তন্মধ্যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার অন্যতম। বছরের প্রথম দিনে ব্যক্তি পুরনো বছরের আত্মপর্যালোচনা করবে। নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা সাজাবে। ঈমান ও আমলের সমৃদ্ধির জন্য কর্মতৎপর হয়ে ওঠবে। এই কাজটি সহজ করার জন্য সবার উচিত- কোরআন-হাদিস চর্চা ও সিরাত-সাহিত্য অধ্যয়নের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। আল্লাহ তাআলা সবার জন্য সহজ করে দিন। আমিন।

