আল্লাহর যেসব বান্দা ইবাদত কামনায় কাতর, সর্বদা মহান প্রভুর সামনে সেজদাবনত হতে চান, তাদের জন্য শীতকাল সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে আগমন করে। মহানবী (স.) শীতকালকে মুমিনের বসন্তকাল হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। (মুসনাদে আহমদ: ১১৬৫৬)
শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় শীতকালে রয়েছে নফল নামাজের অবারিত সুযোগ। প্রখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম। কেননা তা বরকত বয়ে আনে। রাতগুলো দীর্ঘ হয়। ফলে তা ‘কিয়ামুল লাইলের জন্য (রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ) সহায়ক এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে সহজ।’ (আল-মাকাসিদুল হাসানা: ২৫০)
বিজ্ঞাপন
ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, শীতকাল মুমিনদের বসন্ত। কারণ, এ সময়ে মুমিন আল্লাহর আনুগত্যের বাগানগুলোতে আনন্দ-উল্লসিত হয়। ইবাদত-বন্দেগির চারণভূমিতে বিচরণ করে। সহজ-ছোট আমলগুলোর কানন-বীথিতে পরিভ্রমণ করে। (লাতায়িফুল মাআরিফ ফিমা লিল মাওয়াসিমি মিনাল ওজায়িফ, পৃষ্ঠা-৩২৬)
তাহাজ্জুদ নামাজের সওয়াব ও ফজিলত সীমাহীন। কোরআন ও হাদিসে তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। নবী কারিম (স.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে শুরু করে সব যুগের আল্লাহর মকবুল ও প্রিয় বান্দারা ইহকালীন ও পরকালীন উন্নতির জন্য শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ ও ইবাদতকেই প্রধান হাতিয়ার ও মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
আরও পড়ুন: ফরজ বাধ্যতামূলক, নফলে আল্লাহর নৈকট্য
তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় মুত্তাকিরা থাকবে জান্নাতসমূহে ও ঝর্ণাধারায়। গ্রহণ করবে যা তাদের পালনকর্তা তাদের দেবেন। নিশ্চয় ইতঃপূর্বে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত। রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ (সুরা জারিয়াত: ১৫-১৮)
বিজ্ঞাপন
এই আয়াতে জান্নাত ও জান্নাতের নেয়ামতরাজী দানের কথা বলা হয়েছে তাদের জন্য যারা শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনায় লিপ্ত থাকে। বোঝা গেল, শেষ রাতের তাহাজ্জুদের বিনিময় হলো সরাসরি জান্নাত।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে, যা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে ‘মাকামে মাহমুদে’ পৌঁছাবেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৭৯)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা ধৈর্যধারণকারী, সত্যবাদী, নির্দেশ পালনকারী, সৎপথে ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৭)
আরও পড়ুন: তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম কানুন
আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় কর, অভুক্তকে খাবার আহার করাও এবং রাতের বেলা মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় কর। তাহলে তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’ (ইবনে মাজাহ: ১৩৩৪)
হজরত বেলাল (রা.) বলেন, নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই রাতের ইবাদত করবে। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের নিত্য আচরণ ও প্রথা। রাতের ইবাদত আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য অর্জনের উপায়। পাপকর্মের প্রতিবন্ধক, গুনাহসমূহের কাফফারা এবং দেহের রোগ দূরকারী।’ (তিরমিজি: ৩৫৮৯)
অন্য হাদিসে আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন; কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারি: ১১৪৫)
এসব আয়াত ও হাদিসে একদিকে যেমন শেষ রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ইবাদত-বন্দেগির প্রয়োজনীয়তার কথা প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি সীমাহীন ফজিলতের কথাও বিবৃত হয়েছে। নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশের ওয়াদা, আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির ঘোষণা ও গুনাহসমূহ দূর হয়ে যাওয়ার ইশতেহার তো একজন মুমিন মুসলমানের চির কাঙিক্ষত বিষয়।
আরও পড়ুন: তাহাজ্জুদ কষ্টকর হলে ন্যূনতম যে আমলটি করবেন
সহজে তাহাজ্জুদ আদায়ের সুবর্ণ সময় অতিবাহিত হয়ে চলেছে এখন। যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত এই মহাকল্যাণের ইবাদত অলসতার কারণে আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেলে বড়ই বঞ্চনা ও মাহরুমির শিকার হয়ে যাব আমরা। তাই শীতের রাতকে যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে হবে।
শুধু রাত নয়, শীতের দিনেও নেক আমলের সুযোগ রয়েছে। দিন ছোট হওয়া রোজা রাখতে বেশিক্ষণ উপোস থাকতে হয় না শীতকালে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ (বায়হাকি: ৩৯৪০)
তাছাড়া শীতার্ত মানুষের সেবা করার মাধ্যমে জান্নাত লাভের দারুণ সুযোগ লাভ হয় শীতকালে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে মুমিন অন্য বিবস্ত্র মুমিনকে কাপড় পরিয়ে দিল, মহান আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিয়ে দেবেন।’ (তিরমিজি: ২৪৪৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শীতের রাতে তাহাজ্জুদসহ নফল ইবাদতের তাওফিক দান করুন। পুরো শীতকালকে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

