দোয়া ইবাদতের মগজ। ইসলামে দোয়া একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। ‘মহান আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে অধিক সম্মানিত কোনো কিছু নেই’ (ইবনে মাজাহ: ৩৮২৯)। অহংকার করে যারা এই ইবাদত ছেড়ে দেয় তাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। অহংকারবশত যারা আল্লাহর ইবাদত করে না, তারা লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা মুমিন: ৬০)
ভাগ্য পরিবর্তনে দোয়া অসামান্য ভূমিকা পালন করে। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তাকদিরের বিরুদ্ধে সতর্কতা কোনো কাজেই আসবে না। যা ঘটেছে ও যা ঘটতে পারে—তা থেকে শুধু দোয়াই পারে নিষ্কৃতি দিতে। কোনো কোনো দুর্দশার সঙ্গে মোকাবেলা করে বিচার দিন পর্যন্ত লড়াই করতে থাকে দোয়া।’ (তাবরানি আউসাত: ১৫১৯)
বিজ্ঞাপন
১২টি ফজিলতপূর্ণ দোয়া নিচে উল্লেখ করা হলো।
(১) ১০ লাখ নেকি ও মর্যাদা লাভের দোয়া: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ، وَهُوَ حَيٌّ لاَ يَمُوْتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ইউহয়ী ওয়া ইউমিতু, ওয়াহুয়া হাইয়্যু লা ইয়ামূতু, বিয়াদিহিল খাইরু, ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাই-ইং কাদির।’ অর্থ: ‘আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক, তার কোনো অংশীদার নেই, সকল ক্ষমতা তাঁরই, সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য, তিনিই জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনি চিরঞ্জীব, কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না, তাঁর হাতেই মঙ্গল এবং তিনিই সবসময় সকল কিছুর ওপর ক্ষমতার অধিকারী।’ ‘যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করে এই দোয়াটি পড়বে তার জন্য আল্লাহ তাআলা ১০ লাখ নেকি বরাদ্দ করবেন। একইসঙ্গে ১০ লাখ গুনাহ মাফ করবেন এবং ১০ লাখ গুণ সম্মান বৃদ্ধি করবেন।’ (তিরমিজি: ৩৪২৮; ইবনে মাজাহ: ৫/২৯১, হাদিস: ৩৮৬০; হাকেম: ১/৫৩৮)
(২) জ্ঞানার্জনের দোয়া: اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي، وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي، وَزِدْنِي عِلْمًا وأعُوْذُ بِاللَّهِ مِنْ حَالِ أهْلِ النَّار ‘আল্লাহুম্মানফা-নি বিমা আল্লামতানি, ওয়া আল্লিমনি মা ইয়ানফাউনি ওয়া জিদনি ইলমা, ওয়া আউজুবিল্লাহি মিন হালি আহলিন না-র।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনি যা শিখিয়েছেন, তা দিয়ে আমাকে উপকৃত করুন, আমার জন্য যা উপকারী হবে, তা আমাকে শিখিয়ে দিন এবং আমার ইলম (জ্ঞান) বাড়িয়ে দিন আর আমি জাহান্নামিদের অবস্থা থেকে হেফাজতের জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৯; ইবনে মাজাহ: ২৫১)
(৩) মসিবত থেকে রক্ষার দোয়া (দোয়া ইউনুস): لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ‘লা ইলাহা ইল্লা আংতা, সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বলিমিন।’ অর্থ: ‘তুমি ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই; তুমি পুতঃপবিত্র, নিশ্চয় আমি জালিমদের দলভুক্ত।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮৮)
বিজ্ঞাপন
(৪) পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার দোয়া: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي دِينِي وَأَهْلِي ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকাল আফিয়াতা ফী দীনী ওয়া আহলী’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি আমার দীন ও আমার পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তা।’ (আদাবুল মুফরাদ: ৭০৩)
(৫) উত্তম জীবন ও সচ্ছলতার দোয়া: اَللَّهُمَّ اِنِّى أَسْألُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা; ওয়াত তুক্বা; ওয়াল আফাফা; ওয়াল গেনা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে হেদায়াত কামনা করি এবং আপনার ভয় তথা তাকওয়া কামনা করি এবং আপনার কাছে সতীত্ব তথা নৈতিক পবিত্রতা কামনা করি এবং সম্পদ তথা সামর্থ্য বা সচ্ছলতা কামনা করি।’ (মুসলিম: ২৭২১; তিরমিজি: ৩৪৮৯; ইবনে মাজাহ: ৩৮৩২; মুসনাদে আহমদ: ৩৬৮৪, ৩৮৯৪)
(৬) দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে সর্বোত্তম দোয়া: اللَّهمَّ إنِّي أسألُك المعافاةَ في الدُّنيا والآخرةِ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল মুআফাতা ফিদ্দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ।’ অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের নিরাপত্তা কামনা করি। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, বান্দা যত রকম দোয়া করে তার মধ্যে ‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের নিরাপত্তা কামনা করি’—এ দোয়ার চেয়ে উত্তম কোনো দোয়া নেই। (ইবনে মাজাহ: ৩৮৫১) অথবা: رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ রাব্বানা আতিনা ফিদ্ দুনইয়া হাসানাহ্, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাহ্। ওয়াকিনা আজাবান্নার। অর্থ: হে আমার প্রভু! আমাকে দুনিয়াতে সুখ দান কর, আখেরাতেও সুখ দান কর এবং আমাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। (সুরা বাকারা: ২০১)
(৭) ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعَتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ ‘আল্লা-হুম্মা আনতা রব্বী, লা- ইলা-হা ইল্লা- আংতা খলাকতানী, ওয়া আনা- ’আবদুকা, ওয়া আনা- ’আলা- ’আহদিকা, ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্ব’তু, আ’ঊযুবিকা মিন শাররি মা- সনা’তু, আবূউলাকা বিনি’মাতিকা ’আলাইয়্যা, ওয়া আবূউ বিযামবী ফাগফিরলী, ফাইন্নাহূ লা- ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা- আংতা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ এবং আমি তোমার দাস। আমি তোমার কাছে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির ওপর সাধ্যমতো দৃঢ় আছি। আমি আমার কৃতকর্মগুলোর অনিষ্টকারিতা থেকে তোমার আশ্রয় চাচ্ছি। আমার ওপর তোমার অনুগ্রহ স্বীকার করছি এবং আমি আমার পাপগুলো স্বীকার করছি। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কেননা তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই। সহিহ বুখারির বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এই দোয়া পাঠ করবে, দিনে পাঠ করে রাতে মারা গেলে কিংবা রাতে পাঠ করে দিনে মারা গেলে, সে জান্নাতবাসী হবে।’ (বুখারি, মেশকাত: ২৩৩৫)
(৮) রিজিক বৃদ্ধির দোয়া: اللَّهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِهِ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ ‘আল্লাহু লাতীফুম বি-ইবাদিহি ইয়ারজুকু মাইয়্যাশায়ু, ওয়া হুয়াল কাভিয়্যুল আজিজ।’ অর্থ: ‘আল্লাহ তাআলা নিজের বান্দাদের প্রতি মেহেরবান। তিনি যাকে ইচ্ছা রিজিক দান করেন। তিনি প্রবল, পরাক্রমশালী।’ (সুরা শুরা: ১৯)
(৯) আজানের দোয়া (নবীজির শাফায়াত লাভের দোয়া): ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺭَﺏَّ ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟﺪَّﻋْﻮَﺓِ ﺍﻟﺘَّﺎﻣَّﺔِ، ﻭَﺍﻟﺼَّﻼَﺓِ ﺍﻟْﻘَﺎﺋِﻤَﺔِ، ﺁﺕِ ﻣُﺤَﻤَّﺪﺍً ﺍﻟْﻮَﺳِﻴﻠَﺔَ ﻭَﺍﻟْﻔَﻀِﻴﻠَﺔَ، ﻭَﺍﺑْﻌَﺜْﻪُ ﻣَﻘَﺎﻣَﺎً ﻣَﺤﻤُﻮﺩﺍً ﺍﻟَّﺬِﻱ ﻭَﻋَﺪْﺗَﻪُ উচ্চারণ: ‘আল্লা-হুম্মা রাব্বা হা-জিহিদ দা‘ওয়াতিত তা-ম্মাতি ওয়াস সালা-তিল ক্বা-য়িমাতি, আ-তি মুহাম্মাদান আল ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদীলাতা, ওয়াব‘আসহু মাকা-মাম মাহমূদানিল্লাযী ওয়াআদতাহ’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহ্বান এবং প্রতিষ্ঠিত সালাতের তুমিই প্রভু! মুহাম্মদ (স.)-কে অসিলা তথা জান্নাতের একটি স্তর এবং ফজিলত তথা সকল সৃষ্টির উপর অতিরিক্ত মর্যাদা দান করুন। আর তাঁকে মাকামে মাহমূদে (প্রশংসিত স্থানে) পৌঁছে দিন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাঁকে দিয়েছেন।’ (বুখারি: ১/২৫২,নং ৬১৪) জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মুয়াজ্জিনের আজান শুনে যে ব্যক্তি উপরের বাক্যগুলো বলবে, তার জন্য কেয়ামতের দিন আমার শাফায়াত পাওনা হয়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি:১/২২২, নং: ৫৮৯)
(১০) শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তার দোয়া: أَعُوذُ بِاللهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ ‘আউজুবিল্লাহিল আজিম ওয়া বিওয়াজহিল কারিম ওয়া সুলত্বানিহিল কাদিমি মিনাশ শাইত্বানির রাঝিম।’ অর্থ: ‘আমি মহান আল্লাহর কাছে; তাঁর মহানুভব চেহারার কাছে; তাঁর অনাদি-অনন্ত কর্তৃত্বের কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাই।’ হজরত উক্ববাহ (রা.) বললেন, ‘কেউ এ দোয়া পড়লে শয়তান বলতে থাকে যে, এ লোকটি আমার (অনিষ্ট ও কুমন্ত্রণা) থেকে সারা দিনের জন্য বেঁচে গেল।’ (নাসায়ি, ইবনে মাজাহ, দারেমি, মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ: ৪৬৬)
(১১) যে দোয়া পড়লে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়: رَضيتُ بالله رَبّاً ، وبالإسلامِ ديناً ، وبمحمَدٍ نَبِيًّا وَّرَسولاً ‘রাদিতু বিল্লাহি রাব্বাউঁ ওয়া বিল ইসলামী দ্বিনাউঁ ওয়া বিমুহাম্মাদিন নাবিয়্যাঁও ওয়া রাসুলা’। অর্থ: “আমি আল্লাহকে রব, ইসলামকে দীন এবং মুহাম্মদ (স.)-কে রাসুল হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি।’ হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি এই দোয়া পাঠ করবে, তার জন্যে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।’ (মুসলিম: ১৮৮৪; আবু দাউদ: ১৫২৯; মুজামু কাবির: ৮৩৮; মুজামুস সাহাবাহ: ১৬৯৬)
(১২) সর্বাধিক সওয়াব লাভের দোয়া: سبحان الله العظيم وبحمده ‘সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়া বিহামদিহি।’ অর্থ: আল্লাহ পবিত্র, মহান-শ্রেষ্ঠতর। সকল প্রশংসা তাঁরই। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে ১০০ বার বলবে ‘সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়া বিহামদিহি’ এবং সন্ধ্যায় উপনীত হয়েও অনুরূপ বলবে, সৃষ্টিকুলের কেউ তার সমপরিমাণ মর্যাদা ও সাওয়াব অর্জন করতে পারবে না। (আবু দাউদ: ৫০৯১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উল্লেখিত দোয়াগুলো মুখস্থ করার এবং নিয়মিত আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।