বাগেরহাট। ঐতিহ্যবাহী সব মসজিদের শহর এটি। বিশ্ব সাংস্কৃতির ঐতিহ্যটিও অবস্থিত এখানেই। ১৫ শতকের দিকে ঐতিহাসিক মসজিদের এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন উলঘ খান-ই-জাহান। পরে ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হয় এটি। সেসময় বাগেরহাটের ১৭টি স্থাপনাকে তালিকাভুক্ত করা হয়, যার ১০টিই মসজিদ। এই শহরে বিশ্ব-ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগুনি মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, জিন্দা পীরের মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, রন বিজয়পুর মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ ও এক গম্বুজ মসজিদের অবস্থান। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ষাটগম্বুজ মসজিদ।
ষাটগম্বুজ মসজিদ
বিজ্ঞাপন
অতুলনীয় নকশায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি। বাগেরহাটের নামের সাথে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে মিলে মিশে একাকার নামটি। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশও এটি। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটিতে গম্বুজ আছে ৮১টি। নাম যাই হোক, পাঁচ শতাব্দীর অধিক কাল ধরে দেশ-বিদেশের অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে এই মসজিদটি। প্রচলিত অর্থে এই মসজিদের কোনো ছাদ নেই। অর্ধডিম্বাকার ও আয়তাকার গম্বুজগুলোই হচ্ছে এর ছাদ। এজন্য মসজিদটি ছাদ গম্বুজ মসজিদ হিসেবে একসময়ে পরিচিতি লাভ করে বলে শোনা যায়। কালের বিবর্তনে বিকৃত কথ্য রূপে পরিবর্তন হয়ে যা পরবর্তীতে হয়েছে ষাটগম্বুজ। তবে এ নিয়ে এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কথা প্রচলিত রয়েছে। মসজিদটি দেখতে দেশ- বিদেশের হাজারো মানুষ ভিড় জমায়। এখানে প্রতিনিয়তই আনাগোনা থাকে পর্যটকদের।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভেতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু। মসজিদ এলাকায় একটি জাদুঘর রয়েছে।
চৌদ্দ শ’ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে সুদুর দিল্লির জৌনপুর থেকে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে এতদাঞ্চলে আগমন করেন মহান সাধক হযরত খানজাহান (রহঃ)। এ সময় ৬০ হাজার ভক্ত ও মুসলিম সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী তার সাথে ছিল বলে এলাকায় কথিত রয়েছে। দীর্ঘ এ পথ যাত্রায় তিনি প্রথমে রাজশাহীর সোনা মসজিদ এলাকায় আসেন। পরে সেখান থেকে ফরিদপুর, যশোরের বারো বাজার, খুলনার বাশুয়ারী, ফুলতলা হয়ে বাগেরহাট এসে তাবু স্থাপন করেন। এখানে এসে বন-জঙ্গল পরিস্কার করে ২০ বর্গমাইলের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যার নাম দেন খলিফাতাবাদ। তিনি খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রজা সাধারনের সুবিধার জন্য প্রথমে জাঙ্গাল বা রাস্তা তৈরী করেন। দক্ষিণাঞ্চলের লবনাক্ততার কবল থেকে প্রজাসাধারনের সুপেয় পানির জন্য খনন করেন একাধিক দীঘি-নালা। কথিত আছে এ অঞ্চলে তিনি ৩৬০টি দীঘি খনন করেন। নির্মাণ করেন ছোট-বড় ৩৬০টি মসজিদ ও সরাইখান। এ অঞ্চলে হযরত খানজাহান (রহঃ) এর অমর কীর্তির প্রধান নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদ। যা আজও স্ব-মহিমায় দাড়িয়ে আছে।
চুনাখোলা মসজিদ
বিজ্ঞাপন
চুনাখোলা মসজিদ। ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পশ্চিমে অবস্থান এটির। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদসহ তৎকালীন ‘খলিফতাবাদ’ নগর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ নির্মিত প্রাচীন নগরীর অংশ হিসেবে এই মসজিদটিকে ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর আগে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার চুনাখোলা মসজিদকে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়।
এক গম্বুজ বিশিষ্ট র্বগাকৃতির মসজিদটির বাইরের অংশ দৈর্ঘ্যে লম্বায় প্রায় ৪০ ফুট এবং প্রস্থে ২৫ ফুট। পূর্বদিকে ১টি বড় (প্রধান) দরজাসহ মোট ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ১টি করে মোট ২টি দরজা রয়েছে। পূর্বদিকের বড় দরজাটির উচ্চতা ৯ফিট, প্রস্থ ৪ফিট ৪ইঞ্চি এবং ছোট ২টি দরজার উচ্চতা ৭ফিট এবং প্রস্থ ৩ফিট। উত্তর-দক্ষিণ দিকের দরজা ২টির উচ্চতা ৯ফিটের বেশি এবং প্রস্থ ৫ফিট করে।
মসজিদের মধ্যে ১টি কেন্দ্রীয় মেহরাব ও ২টি ছোট মেহরাব রয়েছে। বড়টির উচ্চতা ৭ফিট ও প্রস্থ ৪ফিট। ছোট মেহরাব ২টির উচ্চতা ৪ফিট প্রায় এবং প্রস্থ ৩ফিট। মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব ৭ফুট ৮ইঞ্চি এবং বাইরের চার কোণের চারটি খান জাহানি-রীতি অনুযায়ী গোলাকার ইটের খাম্বা বা পিলার রয়েছে। মসজিদে স্থানীয়রা নিয়মিত নামাজ আদায় করে। লোকালয় থেকে মসজিদে যাওয়ার জন্য একটি ইটের সড়ক করা হয়েছে।
নয় গম্বুজ মসজিদ
ঠাকুর দিঘী বা খাঞ্জেলী দিঘীর পশ্চিম পাড়ে ১৬.৪৫ মি. থেকে ১৬.১৫ মি. ভূমি পরিকল্পনায় নির্মিত নয়গম্বুজ মসজিদটি অবস্থিত। এর দেয়ালগুলো ২.৫৯ মি. পুরো। মসজিদের ছাদ ৯টি নিচু অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশ পথ এবং পশ্চিম দেয়ালে পোড়া-মাটির ফুল ও লতা পাতায় অলংকৃত তিনটি মেহরাব রয়েছে।
অন্যান্য মসজিদের মতো এ মসজিদের কেন্দ্রীয় মেহরাবটিও অপেক্ষাকৃত বড়। মসজিদের কার্নিশ সামান্য বক্র। মসজিদের ভেতরের একটি পিলারে বড় আকারের তেলতেলে গর্ত রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে কোনো এক পীর আঙ্গুলের খোছায় ওই গর্ত করেছিলেন। মসজিদের কার্নিশ সামান্য বক্র। এ মসজিদে এখনও নিয়মিত নামাজ পড়েন স্থানীয়রা।
জিন্দা পীরের মসজিদ
বর্গাকারে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত। জিন্দাপীর মাজার কমেপ্লেক্সের উত্তর-পশ্চিম কোণে মধ্যযুগীয় এই মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি বর্গাকার ভূমি পরিকল্পনায় (৬মিঃ-৬মিঃ) নির্মিত এটি একগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।
এই মসজিদের চারপাশের চারটি গোলাকার বুরুজ রয়েছে। মসজিদের দেয়ালগুলো গড়ে ১.৫২মিঃ পুরু। পূর্ব বাহুতে ৩টি, উত্তর ও দক্ষিণ বাহুতে একটি করে খিলান দরজা আছে। সামনের বাহুতে আছে তিনটি মেহরাব। ছাদের অর্ধগোলাকার গম্বুজটি ভাঙ্গা অবস্থায় ছিল। ২০০২ সালে এটিকে প্রত্নতাত্তিক সংস্কারের মাধ্যমে পূর্ণ অবয়ব প্রদান করা হয়েছে।
দশ গম্বুজ মসজিদ
ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে পূর্বে রনবিজয়পুর গ্রামে অবস্থিত এ মসজিদটিতে দশটি গম্বুজ রয়েছে। খানজাহান আমলের মসজিদ বলে জনশ্রুতি থাকলেও ইতিহাসবিদরা এটিকে খানজাহান পরবর্তী হোসেন শাহ-ই আমলের মসজিদ বলে উল্লেখ করেছেন। ৫০.৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮.১০ ফুট প্রস্থ মসজিদটিতে এখন আর আগের অবয়ব নেই। সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে মসজিদটি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়েছে।
মসজিদের সামনে একটি বারান্দা ও উত্তর পাশে কবর স্থান রয়েছে। সড়ক থেকে মসজিদে ঢোকার জন্য একটি সু-সজ্জিত গেট করা হয়েছে। মূল মসজিদের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দু’টি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ছাদে ওঠার জন্য একটি সিঁড়ি রয়েছে। এ মসজিদে বর্তমানে স্থানীয় লোকজন নামাজ আদায় করেন। বিপরীত দিকে মসজিদের নামে একটি হাফেজিয়া মাদরাসা রয়েছে।
রণবিজয়পুর মসজিদ
ষাটগম্বুজ মসজিদের দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে রণবিজয়পুর গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকার (১৮.৪৯/১৮.৪৯মি.) মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি বাংলাদেশে প্রাচীন আমলে নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের মধ্যে সর্ববৃহত। মসজিদের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশ পথ এবং পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। মসজিদটিতে স্থানীয় লোকজন নামাজ আদায় করে এখনও।
রেজা খোদা মসজিদ
বাগেরহাট শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার ও ষাটগম্বুজ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক রেজাখোদা মসজিদ। বর্তমানে মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। ধারণা করা হয়, এটি ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ছিল। বর্তমানে শুধু দেয়ালের কিছু কিছু অংশ ও খিলানযুক্ত মেহরাবের অংশ বিশেষ টিকে আছে। প্রায় অর্ধশত বছর আগে স্থানীয় লোকজন মসজিদের ওই জায়গায় নতুন করে একটি টিনসেড মসজিদ নির্মাণ করে। সেখানে এখন নামাজ আদায় করে স্থানীরা।
এক গম্বুজ মসজিদ
খান-জাহান-আলী (রহ.)-এর মাজারের পশ্চিম পাশে এবং ঠাকুর দিঘীর পূর্ব পাড়েই এ মসজিদটি অবস্থিত। সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে একগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের মূল অবয়ব এখন বোঝা যায় না। এখানে মসজিদের খাদেম ও দিঘির আশপাশের লোকজন নামাজ পড়ে। খানজাহানের ভক্তবৃন্দ মাজার জিয়ারতের পরে এখানে নামাজ আদায় করেন।
সিংগাইর মসজিদ
ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মধ্যযুগীয় এই মসজিদটি অবস্থিত। এটি একগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। মসজিদের (বাইরের দিকের ১১.৮৮ মিঃ x ১১.৮৮মিঃ) পলেস্তরাবিহীন দেয়ালগুলো গড়ে ২.১০মিঃ পুরু। প্রত্যেক কোণে বাইরের দিকে গোলাকারে বর্ধিত একটি করে সংলগ্ন বুরুজ রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে খিলান দরজার সংখ্যা ৩টি। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের প্রতিটিতে খিলান দরজার সংখ্যা ১টি। পূর্ব দেয়ালের মাঝের খিলানটির আকার অন্যগুলোর চেয়ে বড়। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে দুপাশে দুটি কুলঙ্গীসহ একটি অবতল মেহরাব আছে। অনুরূপ কুলঙ্গী উত্তর ও দক্ষিণের দরজাগুলোর দুপাশেও আছে। অন্যান্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ষাটগম্বুজ মসজিদের অনুরূপ। কেবলমাত্র চার কোণের চারটি সংলগ্ন গোলাকার বুরুজ মসজিদের কার্নিশ পর্যন্ত উঠানো।
এইউ