ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দুটোই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ। আয়তনের দিক থেকে ব্রাজিল বিশ্বে পঞ্চম এবং দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ। আর আয়তনে বিশ্বে অষ্টম ও দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলে ২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমান ১৭ লাখের মতো। যা মোট জনসংখ্যার ৫-৬ শতাংশ। আর্জেন্টিনায় ৪ কোটি ৪৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমান প্রায় ৮ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ।
ব্রাজিল
ব্রাজিলে ২০ কোটি লোকসংখ্যার বেশির ভাগই ক্যাথলিক খ্রিস্টান। অন্যান্যদের মধ্যে প্রটেস্টান্ট ২২ শতাংশ। এই দেশটিতে গাণিতিক হিসাবে মুসলিম জনসংখ্যা কম মনে হলেও আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, ব্রাজিলে মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সাওপাওলোতেই মাসে গড়ে ছয়জন মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে। (সূত্র: ‘আল-মুসলিমুনা ফিল ব্রাজিল, ড. খালিদ রিজক তকিউদ্দিন)
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে ব্রাজিলের প্রতিটি শহরেই মসজিদ আছে। ব্রাজিলে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ১৩০টি। ২০০০ সালের তুলনায় মসজিদের সংখ্যা এখন চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য রয়েছে মক্তব-মাদরাসা ও ইসলামিক স্কুল।

গত শতাব্দীতে ও বর্তমানে ব্রাজিলে হিজরতকারী বেশির ভাগ মুসলমান ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। ব্রাজিলের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছেন মুসলিম ব্যবসায়ীরা। কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের প্রতি ব্রাজিল সবসময় ঋণী হয়ে থাকবে। আখ-চিনি, কফি, তুলা, বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা, এমনকি প্রয়োজনীয় সব ধরনের কৃষি সরঞ্জামাদি তারা আফ্রিকা থেকে ব্রাজিলে নিয়ে এসেছিল।
অন্যান্য পেশার সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম—চাকরি, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও খেলাধুলায়ও মুসলমানরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে।
বিজ্ঞাপন
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রাজিলে ইসলামের আগমন আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের সূচনালগ্ন থেকেই। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল বিখ্যাত পর্তুগিজ পরিব্রাজক ও আবিষ্কারক পেড্রো আলভারেস কারব্যাল যখন ব্রাজিল উপকূলে জাহাজ নোঙর করেন, তখন তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু স্বনামধন্য, দক্ষ, কর্মঠ ও পারদর্শী মুসলিম নাবিক ছিলেন। তন্মধ্যে শিহাবুদ্দিন বিন মাজেদ ও মুসা বিন সাতি অন্যতম। ইতিহাসের বরাত অনুযায়ী তাঁদের হাত ধরেই ব্রাজিলে ইসলাম ও মুসলমানের আগমন ঘটে। (আল-ইসলাম ওয়াল মুসলিমুন ফিল ব্রাজিল, আল-মুজতামা অনলাইন সংস্করণ-২০১)

এছাড়াও ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে ১৪ হাজারের বেশি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মুসলমান আফ্রিকা থেকে ব্রাজিলে স্থানান্তরিত হয়। পর্তুগিজরা পরবর্তী সময়ে নিগ্রো মুসলিমদের বেশি হারে নিয়ে আসতে শুরু করে। এমনকি শুধু অ্যাঙ্গোলা থেকেই ছয় লাখ ৪২ হাজার নিগ্রো মুসলিমকে ব্রাজিলে নিয়ে আসা হয়। এছাড়া সুদানের বিভিন্ন অঞ্চল ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের ব্রাজিলে নিয়ে যাওয়া হয়। এসব নিগ্রো মুসলমানকে জোরপূর্বক ব্রাজিলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের হাত-পা শিকলে বেঁধে জাহাজের পাটাতনে ফেলে নিয়ে যাওয়া হতো। নির্যাতন-অবহেলা, অনাহারে ও রোগাক্রান্ত হয়ে যেসব মুসলমান মারা যেত, তাদের মাঝপথে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। (সূত্র: ব্রাজিল জা-রাহাল মুসলিমুনা ওয়াকতাশাফুহা কাবলাল বুর্তুগালিয়িন)
দ্বিতীয় মাত্রায় ১৮১৪ ও তৃতীয় মাত্রায় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ব্রাজিলে হিজরত করে। মূলত ব্রাজিলের মুসলমানদের জন্য সুদিন আসতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। লেবানন, ফিলিস্তিন, মিসর ও সিরিয়া থেকে মুসলমানরা ব্রাজিল আসতে থাকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ও লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় এবং ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিল সম্রাট মিসর, লেবানন ও সিরিয়া সফর করার পর থেকে। রাজা দ্বিতীয় পেড্রোর সঙ্গে চুক্তি হয় লেবাননের। লেবানিজরা ব্যবসা করার জন্য আসতে শুরু করে দেশটিতে। অন্যদিকে আরব বসন্তের পর গত কয়েক বছরে চার শতাধিক সিরিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে শতাধিক মুসলিম পরিবার ব্রাজিলে আশ্রয় নিয়েছে।
আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার মধ্যে রোমান ক্যাথলিক ৯২ শতাংশ, প্রটেস্টান্ট ২ শতাংশ, ইহুদি ২ শতাংশ, অন্যান্য ৪ শতাংশ, আর মুসলমান প্রায় ২ শতাংশ। (সূত্র : ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক)
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে মোট জনসংখ্যার বিচারে আর্জেন্টিনায় সবচেয়ে বেশি মুসলিম বাস করে। মুসলমানরা ধর্মীয় দিক থেকে বেশ স্বাধীনভাবেই এখানে ধর্ম পালন করতে পারে। পবিত্র রমজান, ঈদসহ সব ইসলামি উৎসব তারা বেশ আনন্দের সঙ্গে পালন করে।

ইবাদতের সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে বড় বড় ইসলামিক সেন্টার, মসজিদ ইত্যাদি। যার মধ্যে সিআইআরএ (দ্য ইসলামিক সেন্টার অব আর্জেন্টিনা), আহমদ মসজিদ, আত-তাওহিদ মসজিদ, কিং ফাহাদ বা পালার্মো মসজিদ অন্যতম। সঠিক দীন শিক্ষার জন্য মসজিদগুলোতে রয়েছে বিশেষ কোর্স। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও পবিত্র রমজান মাসে ইসলামি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে মুসল্লিরা তাদের যেকোনো প্রশ্নের সমাধান মুফতি সাহেবদের থেকে নিতে পারেন।

একই সঙ্গে মসজিদগুলোতে বাড়ছে মুসল্লিদের সংখ্যাও। নাইন-ইলেভেনের পর সেখানকার মুসলিমরাও প্রথম দিকে বেশ বিপর্যয়ের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও সে দেশের সরকার মুসলিমদের প্রতি সহনশীল হওয়ায় সহজেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তারা।
ইতিহাস অনুযায়ী, আর্জেন্টিনায় যখন স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ কলোনি ছিল, তখন এখানে কাজ করার জন্য বহু পশ্চিম আফ্রিকান মানুষ ধরে আনা হতো। স্বভাবতই তারা ছিল মুসলিম। পরবর্তীকালে সিরিয়া, লেবাননসহ বিভিন্ন আরব দেশ থেকে অনেক মুসলমান অভিবাসী এখানে এসে বসত গড়ে। বর্তমানে বেশির ভাগ মুসলিমই দেশটির রাজধানী বুয়েনস আয়ারসে বসবাস করে।

